B-62# বাবার দুঃখ( বড়দির গল্পের ষষ্ঠ ভাগ)

বাবার দুঃখ( বড়দির গল্পের ষষ্ঠ ভাগ)
যাক বাড়ি  পৌঁছলাম কিন্ত বেশ রাত করে, এতটা পথ কাছের রাস্তা তো নয় । বাবা বসে আছেন, দূর থেকেই বুঝতে পেরেছি। কতবার বলেছি সে কেদারায় না বসতে, বাবা  বসবেই ।এতকাল এই কেদারাটা খারাপ ছিল, মাঝের ঐ কাপড়টা  পচে গিয়েছিলো, কিন্ত কে কার কথা শোনে, আমি ছিলাম না নিশ্চয় বাবা কাপড় কিনে এনে দর্জি দিয়ে সেলাই করে, কাঠের কাঠামো টাকে মেরামত করেছে। বাতিলের খাতায় ছিল সেই কেদারা, ভাড়ার ঘরে ছিল বহু বছর। আসলে বাবারা এমনই হয় , একটা বয়সের পর সব বাবারাই  নিজের বাবার সত্বাকে নকল করতে করতে গড়ে ফেলেন পুরোপুরি নিজেকে। যেমন ধরুন যেকোনো পুরোনো জিনিস অতি যত্নে প্লাস্টিকে মুড়িয়ে গুঁজে রাখেন, আবার নিজেই সে সব খুঁজে পান। কোথাও ঘুরতে গেলে আজ পর্যন্ত ফার্স্ট ক্লাসে যান না, ব্যাখ্যা টা কিন্তু উনি  দারুন  বলেন, ট্রেনে সামনের মানুষের সাথে একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী হয়, আবার প্রকৃতির সাথে একটা ছুঁটতে থাকার নিবিড় সম্পর্ক, ট্রেনের পাটাতনের সেই ঢেক ঢেক আওয়াজ, ওগুলো নাকি  ফার্স্ট ক্লাসে পাওয়া যায় না। আসলে পুরোটাই একটা বানানো দাম্ভিকতা। কথা বলতে গেলেই কেমন যেন একটা গা ছাড়া ভাব, ভাবে সে প্রমান করে, আপনি সেকেলে, বা আধুনিক নন।

         বস বস, কাপড় ছাড়তে হবে না, আগে বল কেমন দেখলি মিতুর শ্বশুরবাড়ি, প্রথম থেকে বল।জানি গ্রাম দেশ কষ্ট হবে, পারবে বল সব কিছু মানিয়ে নিতে, কি বলিস? তোর মা ও তো গ্রামেই বড় হয়েছে, তবে অজ পাড়াগাঁ না আমাদের বাঙলাদেশের মত, বিয়ের পর তো কত শুনিয়েছে আমায় তোমরা তো ছিলে “হাল্লা চাষা”, এখন না হয় উন্নত হয়েছো। কি গো কোথায় গেলে আসবে তো? মেয়ের শ্বশুর বাড়ির গল্প শুনবে না। তবে দেশ ভাগ না হলে তো সে দেশেই থাকতাম তখন ও তো মিতুর হয়তো সে দেশের কোনো এক গ্রামেই হয়তো বিয়ে হতো। তখন তো মনকে মানিয়ে নিতাম, তাই এখন আর সে দুঃখ পাই না।

          আরে তোমরা কথা বলো না, আমি তো সব শুনছি, রান্না ঘর থেকেই তো উত্তর দিচ্ছি, কিছুক্ষন পরেই তো খেতে চাইবে ।
আজ তোমার যা অবস্থা আমার বাবারও একই দশা হয়েছিল যেদিন বিয়ে দিয়ে আমায় শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়েছিল। তবে হ্যাঁ আজ ঐ কথাটা বলতে খারাপ লাগে মানে “হাল্লা চাষা”।[ স্বীকার করতে লজ্জা হয় না যে আমার শ্বশুরবাড়িটা ছিল অনেক শিক্ষিত, আর আমার বাপের বাড়ি ছিল তবে এতো শিক্ষিত নয়, বাপের বাড়িতে যেটা ছিল সেটা হোলো রেঙ্গুনের কাঁচা পয়সা। যেদিন থেকে বিয়ে হোলো তোমায় নিয়ে কতবার গেছি, মা বাবার আপ্যায়ন সে আর ভোলার নয়, কিন্ত দাদারা কেমন যেন শুধুই নিজেদের কাজ নিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যে বেলা পর্যন্ত ব্যস্ত, সেটা হতেই পারে। খারাপ লাগতো রবিবার, সেদিনও দাদা, বৌদি কে নিয়ে বেরিয়ে যেত সঙ্গে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে, আসতো কত রাতে তবে হ্যাঁ খেতে বসতাম একসাথে তখনই যা দেখা। দু চারটে খাবার টেবিলে যা কথা, কিন্তু বেশির ভাগটাই তাদের নিজেদের গল্প নিয়ে কেটে যেত। বিয়ের পর দাদা একবারও জিজ্ঞাসা ও করে নি তোর শ্বশুর বাড়িটা কেমন, বাড়ির লোকজন সবাই তোর খেয়াল রাখে কিনা, যেমনটা মেয়েরা বাপের বাড়িতে আসলে হয় আর কি। অথচ এই দাদাই আমাকে বাংলাদেশে মানে আমাদের গ্রামের বাড়ি চন্দনডি তে প্রতিবছর মেলা আসতো  কতদিন আমায় ঘুরতে নিয়ে গেছে, কতকিছু কিনে দিত, দাদাকে তো বাবার জায়গায় স্থান দিয়েছিলাম কত বড় আমার থেকে একুশ বছরের বড়।

দুর্গাপুজো আসলে তো কথায় নেই। বাবা দাদাকে নিয়ে বর্মার ম্যান্ডেলে শহর থেকে ঠিক পুজোর দিনকুড়ি আগে আসতেন। আমাকে দোকানে নিয়ে গিয়ে কত থান কাপড় কিনে দিতেন রংবাহারি ছিটের কাপড় সেগুলো একেবারে দর্জি দিয়ে মাপ করে তবেই বাড়ি আসতাম।

সমস্ত আবদার গুলো মেটানো সে তো দাদাই করতো। পুজোর চারদিনের সকাল বিকেল মিলিয়ে চার জোড়া জামা কাপড় তো দাদাই কিনে দিতেন।। এই সামান্য টুকুই তো বাবা দাদাদের থেকে চাওয়া। বিয়ের পর  না উনাদের সম্পত্তির উপর কোনো মনের ইচ্ছে, না কোনো লোভ, আজ বুঝি একটা সম্পর্কের পর্দা বরাবরই ঝোলে বিয়ের পর থেকে। বিয়ের পর মেয়েরা যখন বাপের বাড়ি আসে সে তখন খোঁজে তার হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলা আর সে অতীত দিনগুলো। কিন্তু বাড়ির লোকের একটা আপোষহীন মন্তব্য মনটাকে খুব ভার করে দিত   “তুই এখন বৌ কত বড় তোর দায়িত্ব আগামীদিনে “।

আর যে মেয়েটা, মেয়ে থেকে বৌ হোলো সে কখনোই দুটোকে এক করতে পারে না, সে ভাবে বাপের বাড়িই মানে একটা আশ্রয় একটা সব কথা বলার জায়গা, একটা ভরসা, আর সেই দুবিধায় ভাবতে ভাবতে তাকে ফিরে যেতে হয় শ্বশুরালয়ে আর চোখের নিমেষেই মা হয়ে শুরু হয় পরবর্তী জীবন, গাঁট ছাড়া সে জীবন, এক শুধু খবর নেওয়ার বাপের বাড়ির সম্পর্ক]।

এতো ভাবার কি হয়েছে একই জিনিস হবে না তোমার বড়মেয়ের ক্ষেত্রে তাতে আবার নতুন কথা কি। জামাই তো বলেছে মিতুকে বেশিদিন থাকতে হবেনা গ্রামে, মাসদুয়েক পরেই তাকে নিয়ে যাবে ঘাটশিলায়। তার ও তো ঘর বাড়ি দেখতে হবে সেখানে তারপর না হয় যাবে। এই শোনো নিজের মেয়ের জন্য আজ তোমার মন কাঁদছে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে বুঝেছো। আমাকে বিয়ের পর প্রায় একবছর রেখে দিয়েছিলে তোমাদের সেই সীতাকুন্ড গ্রামে, নতুন বৌ বলে  কিছু বলতে পারিনি সেদিন। আজও মনে আছে আমাকে সোনা উঠিয়ে দিয়ে এসেছিলো চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে, সেই প্রথম প্লেনে চাপা।

কি ভয় করছিলো ঘন্টা খানেক লেগেছিলো, আমি তো পুরোটা রাস্তায় চোখ বন্ধ করে রেখেছিলাম ভয়ে। বেড়িয়েই দেখি বাবু খিল খিল করে হাসছেন। যাক সে সবকথা খেতে এসো বেশ রাত্তির হয়েছে।
          যাচ্ছি যাচ্ছি দাঁড়াও না, জানো সেদিন মিতু কি কেঁদেছিলো আমায় জড়িয়ে যেদিন ওকে নিয়ে ওর বিয়ের চটি কিনতে যাই। “ বাবা আমি এভাবে বিয়ে করছি বলে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে বলো, কথা দিচ্ছি বাকি বোনেরা তোমায় সে কষ্ট দেবে না, আমারও খুব খারাপ লাগছে বাবা তোমার কত সে স্বপ্ন ছিল আমায় নিয়ে তা আমি আর হতে দিলাম না। এমনিতে কিন্ত ওরা খুব ভালো অনেক বড় মাপের মানুষ, বাবা দেখবে আমি জিতবোই আর এমন কিছু কাজ করবো না যাতে তোমার ছোটো হতে হয় “। তখন আমি বলেছিলাম,
      মারে জ্ঞানতো কখনো মনে পড়ে না, তোরা যখন যেটা আবদার করেছিস আমি দিই নি। চেষ্টা করেছি তোদের ইচ্ছে গুলো পুরোপুরি মেটাতে। এতো পড়াশুনা করিয়ে বড় করলাম কত শিক্ষিত হলি শেষ পর্যন্ত সেই গ্রাম দেশই বেছে নিলি রে মা।

আমরাও তো গ্রাম দেশ কাটিয়েছি যখন বাংলাদেশে ছিলাম, তারপর দেশ ভাগ হওয়ার সময় দাদা কলকাতায় এলেন আর আমি এলাম উনার পিছু পিছু। সেই পার্কসার্কাসে একটা মেসে থাকতাম, পড়াশুনা করতাম যাদবপুরে সেই থেকেই কলকাতার জীবন শুরু। তারপর হয়তো বাংলাদেশ যেতাম খুবই কম কারণ একটাই ছিল যে শহর দেখেছে তার কাছে আবার করে গ্রামে ফিরতে বড়ই কষ্ট। আর তুই মা শহরে থাকলি এতটা কাল,জোর করে বেছে নিলি সে গ্রাম্য জীবন। গ্রাম গ্রামই হয়, সেখানে কত অভাব পদে পদে অভাব। রাস্তা ঘাটের অভাব, ঘরে সারাক্ষন গরু মানুষের একসাথে থাকার কষ্ট, উপযুক্ত বাথরুমের অভাব, মাটির বাড়ি, পোয়ালের গন্ধ, ধানের গন্ধ, ঠিক মতো আলোর অভাব, রান্নাবান্নার অভাব ও দেশে এখনো মানুষ কাঠের উনানে রান্না করে। যতই বলিস হয়তো দাঁতে দাঁত কামড়ে পরে থাকবি, সে কষ্ট হলেও উগলতে পারবি না আমাদের কাছে। ঠিক আছে এখন তো সবই হয়ে গেছে কি আর করার, তবে একটা কথা রে মা কোনোদিন তাঁদের বলিস না তোর সব ছিল, ওটা ভাবলেই কষ্ট পাবি, আর বললে তো সে অশান্তি বাড়বে। 

     চলো খেয়েনি বেশ রাত্রি হয়ে গেছে, মিতু বোধহয় এতক্ষনে শুয়ে পড়েছে গ্রাম দেশ তো ওরা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে আবার সকালে উঠেও পড়ে সেই কাক ভোরে। হয়তো মিতুর ও অভ্যাস হয়ে যাবে আগামীদিনে।


Comments

sadamata101.blogspot.com

B-47#বিশ্বকর্মা_পূজো

সন্তোষ ঢাকি

B-71#GANESH_PRASADAM. ( গনেশজির ভোগ নিবেদন মোদক ও পূরণ পুলি)