B-53#তর্পনও মহালয়া

                তর্পন ও মহালয়া

এবছর অর্থাৎ 2020 সাল, পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে পিতৃপক্ষ, শেষ হবে ১৭ই সেপ্টেম্বর। পিতৃপক্ষের শেষ আর দেবীপক্ষের সূচনায় তাই সেদিন মহালয়া। প্রতি বছর একটা বিশেষ সময়কে হিন্দু শাস্ত্রে পিতৃ পক্ষ হিসেবে বিবেচিত করা হয়ে থাকে। রীতি অনুযায়ী প্রয়াত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশেই তর্পন করা হয়ে থাকে। রামায়ণ অনুসারে রামচন্দ্র লঙ্কা জয়ের আগে ঐদিনেই তর্পন করেছিলেন।
তর্পনঃ “তর্পন” শব্দটি এসেছে “ত্রুপ” থেকে। “ত্রুপ” কথার মানে “সন্তুষ্ট করা”। ঈশ্বর, ঋষি ও পুর্বপুরুষের আত্মার উদ্দেশে জল নিবেদন করে তাদের সন্তুষ্ট করাকে তর্পন বলা হয়।
আসুন জেনে নেওয়া যাক তর্পনের কিছু নিয়ম হিন্ধু শাস্ত্র মতে:-

তর্পন কি ও কেন করতে হয় 
তর্পনের মন্ত্র 
তর্পনের প্রয়োজনীয়তা

গঙ্গা বা যে কোনো নদীতে স্নান করে সেখানেই তর্পন করার বিধি। স্নানের পর পূর্বমুখী হয়ে নাভিমাত্র জলে যিনি ব্রাহ্মণ তাঁদের ক্ষেত্রে পৈতে বাম কাঁধে রেখে তিলক ধারণ করে, আচমন করার পর শ্রীশ্রী বিষ্ণুকে স্মরণ ও করজোড়ে বলা –
ওঁ তদ্ বিষ্ণোঃ পরমং পদং, সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ।
দিবীব চক্ষুরা ততম্।। ওঁ বিষ্ণুঃ, ওঁ বিষ্ণুঃ,।

এই মন্ত্রে বিষ্ণুকে স্মরণ করিবেন
আচমনের আগে তিনবার নমঃ বিষ্ণু বলে উনাকে স্মরণ করে করজোড়ে বলবেন –

নমঃ  অপিত্রোবা,পবিত্রবা সর্ববাবস্থাং গতোহপিবা,
যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং, স বাহ্যাভ্যন্তরঃ শুচিঃ।
নমঃ শুচি নমঃ শুচি নমঃ শুচি।

।।তীর্থ- আবাহন মন্ত্র।।

এবার যিনি ব্রাহ্মণ তাঁর পৈতে ডানকাঁধে রেখে দক্ষিণমুখী হয়ে করজোড়ে নিচের মন্ত্রটি পাঠ করবেন:
ওঁ নমঃ কুরুক্ষেত্রং গয়া-গঙ্গা-প্রভাস-পুষ্করাণিচ ।
পুণ্যান্যেতানি তীর্থানি তর্পণ-কালে ভবন্তিহ ।।

দেব-তর্পন:-

পূর্বমুখী হয়ে প্রথমে দেব তর্পন করতে হয়, ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে পৈতে বাম কাঁধে রেখে ডানহাত ও বামহাতের মাঝে তাম্রকোষ ধরে তিল ও তুলসী সহযোগে এক অঞ্জলি জল দান করতে হয়। সন্ধ্যা করতে না পারলে সবশেষে সূর্যার্ঘ দেবেন।
ওঁ ব্রহ্মা তৃপ্যতাম্।।s
ওঁ বিষ্ণুস্তৃপ্যতাম্।।
ওঁ রুদ্রস্তৃপ্যতাম্।। 
ওঁ প্রজাপতিস্তৃপ্যতাম্।
পুরাণে তর্পণ

পুরাণ থেকে আমরা জানতে পারি যে জীবিত ব্যক্তির তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই পিতৃলোক স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত একটি স্থান যার অধিষ্ঠাতা দেবতা হলেন স্বয়ং যম। এই মৃত্যুর দেবতা যমই কার্যত মৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য বা পৃথিবী থেকে তাঁর মৃত্যুর পর পিতৃলোকে নিয়ে যান। আর তারপর বংশের পরবর্তী প্রজন্মের কারুর যখন মৃত্যু হয়, তখন সেই ব্যক্তি পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গিয়ে ঈশ্বর বা পরমাত্মায় মিশে যান। অন্যান্য নানা হিন্দু শাস্ত্রগ্রন্থ অনুযায়ী পিতৃপক্ষের সূচনা তখনই হয় যখন সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করে। হিন্দুরা বিশ্বাস করে থাকেন, পিতৃপক্ষের এই সূচনায় তাঁদের পূর্বপুরুষরা পিতৃলোক ত্যাগ করে তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের গৃহে গিয়ে সেখানে অবস্থান করেন। পরে যখন সূর্য আবার যথাসময়ে বৃশ্চিকরাশিতে প্রবেশ করে তখন তাঁরা আবার পিতৃলোকে পুনর্গমন করেন। আর পূর্বপুরুষরা যেহেতু তাঁদের গৃহে অবস্থান করেন তাই তর্পণের উদ্দেশ্যে এইসময় তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন হিন্দুরা।
তর্পনের  প্রচলন কি ভাবে শুরু হয়   তা নিয়ে মহাভারতে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে:-
তর্পণ সম্পর্কে মহাভারতে আমরা একটি কাহিনী পাই। দাতা কর্ণের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মা স্বর্গে গেলে তাঁকে সোনা ও মূল্যবান ধনরত্ন খাদ্য হিসেবে দেওয়া হয়। যথারীতি কর্ণ অবাক হয়ে দেবরাজ ইন্দ্রকে এর কারণ জিজ্ঞেস করেন। তখন দেবরাজ জানান যে কর্ণ তাঁর সারাজীবনে অনেক দানকর্ম করলেও প্রার্থিত ব্যক্তিকে শুধুমাত্র মূল্যবান ধনরত্নই দিয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে কখনও খাবার দেননি।
জীবদ্দশায় পিতৃপুরুষের প্রতি অবহেলা দেখানোর জন্য তাঁকে সোনা ও ধনরত্ন খাদ্য হসেবে দেওয়া হয়েছে। কর্ণ তখন তাঁর অনিচ্ছাকৃত ভুল স্বীকার করে নিলে তাঁকে ষোলো দিনের জন্য আবার পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে খাদ্য ও জল দান করার অনুমতি দেন ইন্দ্র। আর সেই থেকে এই ষোল দিনের পর্ব নাকি পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়। কোনো কোনো জায়গায় এখানে দেবরাজ ইন্দ্রের স্থানে মৃত্যু দেবতা যমকেও আমরা দেখি।
তর্পনের সামগ্রী:-

কুশিতে কুরুক্ষেত্র মন্ত্রপাঠের জল, চন্দন তিল, তুলসী পাতা দিয়ে তর্পন করতে হয়। পিতামাতার তর্পনের সময় জল, চন্দন তিল, তুলসী পাতা ওঁ ত্রিপত্রী এবং অনন্য তর্পনের সময় তিলের পরিবর্তে ধান বা জব লাগবে। তিল,জবের অভাবে কুরুক্ষেত্র মন্ত্রপাঠের জলে তর্পন করা যায়।
তিল তর্পন

তিল তর্পন মানে জল আর তিল একসাথে পূর্বপুরুষের আত্মার উদ্দেশ্যে নিবেদন করতে হয়। সাদা ও কালো – দুই রকম তিল হয় কিন্তু শ্রাদ্ধেতে কালো তিল ব্যবহার করা উচিৎ। যতজনের তর্পন করা হয় প্রত্যেকের উদ্দেশ্যে আলাদা আলাদা তিল নিবেদন করতে হয়। মনে করা হয়, তিল ব্যবহারের মাধ্যমে নেতিবাচক ও আসুরিক শক্তির শ্রাদ্ধকারীর মাঝে প্রবেশ করতে পারে না।
মৃত্যুর পর পরলোকে জীবের গতি"
মৃত্যুর পর পরলোকে জীবের গতির দুটি প্রধান পথের কথা শাস্ত্রে বলা আছে। (১) দেবযান বা উত্তরমার্গ, (২) পিতৃযান বা দক্ষিণমার্গ। সগুণ ব্রহ্মের উপাসক, নিষ্ঠাবান ব্রহ্মচারী, বানপ্রস্থী ও পঞ্চাগ্নির জ্ঞানসম্পন্ন গৃহস্থরা মৃত্যুর পর দেবযান বা উত্তরমার্গে যান। প্রথমে এঁরা অগ্নিলোকে যান, তার পরে শুক্ল পক্ষ, ছয় মাস উত্তরায়ণ, দেবতা, বায়ু, সূর্য প্রভৃতি বিভিন্ন লোক ভ্রমণ করে সব শেষে ব্রহ্মলোকে বা সত্যলোকে উপস্থিত হন। সেখানে আত্মজ্ঞান পেয়ে মুক্তি লাভ করেন। তাঁদেরকে আর সংসারে ফিরে আসতে হয় না। এর নাম ক্রমমুক্তি।
আর যে সব গৃহস্থ সংসারে থেকে অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ এবং ঈষ্ট পূজা ও অন্যান্য পূণ্যকর্মের অনুষ্ঠান করেন তাঁরা পিতৃযান বা দক্ষিণমার্গে যান এবং পরে চন্দ্রলোকে উপস্থিত হন। সেখানে তাঁরা পূর্বজন্মের পূণ্যকর্মের ফল ভোগ করেন। ভোগশেষে সমস্ত পূণ্যকর্ম শেষ হলে আবার এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। এই ভাবে তাঁরা সংসারে বার বার যাতায়াত করেন।
যেহেতু পিতৃপক্ষে প্রেতকর্ম  (শ্রাদ্ধ) , তর্পণ ইত্যাদি মৃত্যু-সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়, সেই হেতু এই পক্ষ শুভকার্যের জন্য প্রশস্ত নয়। দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে গণেশ উৎসবের পরবর্তী পূর্ণিমা (ভাদ্রপূর্ণিমা) তিথিতে এই পক্ষ সূচিত হয় এবং সমাপ্ত হয় সর্বপিতৃ অমাবস্যা, মহালয়া অমাবস্যা বা মহালয়া দিবসে। উত্তর ভারত ও নেপালে ভাদ্রের পরিবর্তে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষকে পিতৃপক্ষ বলা হয়।

Comments

sadamata101.blogspot.com

B-47#বিশ্বকর্মা_পূজো

সন্তোষ ঢাকি

B-71#GANESH_PRASADAM. ( গনেশজির ভোগ নিবেদন মোদক ও পূরণ পুলি)