B-55#কোনো এক গায়ের বধূ ( বড়দি গল্পের পঞ্চম ভাগ)

কোনো এক গায়ের বধূ 
বেশ কিছুদিন থাকতে থাকতে এই গ্রামটা, লোকজন গুলোকে, গ্রামের চারিপাশের চিত্রটার উপর কেমন একটা যেন মায়া পড়ে গেছে। আসলে আমি যেখানেই যাই সেই জায়গাটাকে চেষ্টা করি উপলব্ধি করতে, এই তো গ্রামের এক লোকের সাথে কাল বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম বাঁধ দেখতে, এই বাঁধ যেমন খরার সময় গ্রামকে সারাটা মাঠে জল দেয়  আবার কখনো গ্রাম কে গ্রাম সে জলে নষ্ট করে দেয়।
আজ চলে যাবো বাড়ির জন্য ও মনটা খারাপ লাগছে, দাদার বাড়ির লোকজন না খাইয়ে ছাড়বে না। আমাদের বাড়ির একটা চল আছে  যে কোনো আনন্দ বা দুঃখের দিনেও অনুষ্ঠানের পরের দিন গানবাজনার আসর বসে । তাই বড়দির বাড়িতে নিয়মমাফিক সেই গানের আসর ও বসলো।জ্যেঠতুতো দাদা গান ধরলেন, ছোড়দি আবৃত্তি- সুকান্তের দেশলাই কাঠি, মেজদির নাচ সেই চিত্রাঙ্গদা, আর বড়দির সেই বোকা বোকা একটাই নাচ, বেচারি জানতো না  যে  সে নাচতে পারে না,তাও সকলে জোর করাতে বিন্দুমাত্র লজ্জা পেত না আর সেই একই গান “ফুলকলিরে ফুলকলি বল তো এটা কোন গলি “নির্দ্বিধায় সে নাচতো। বড়দি এই গ্রাম্য জীবনটা বেছে নিয়ে ছিল বলেই হয়তো সে এই গলিটা আপন করতে পেরেছিলো একেবারে বাস্তব জীবনে।
জীবনে কিছু মানুষ থাকে, যা পারে না,কিন্তু জোর করে সে জিনিস করে তার একটাই কারণ মজলিসে উপস্থিত লোকজনকে আনন্দ দেওয়া। আর সে সবার অলক্ষেই স্থান পায় প্রত্যেকের মনিকোঠায় একেবারে শীর্ষে । তাই আবার কখনো সে মজলিস হলে মানুষ তাঁকেই বারবার খোঁজে কারণ মানুষ আনন্দ করতে পছন্দ করে শিল্প তো যার যার নিজস্ব ব্যক্তিগত সত্বা। লোককে হাসানো বা কাঁদানো এও তো আরেক শিল্প। সে শিল্প বড়দির ছিল। তবে হ্যাঁ আক্ষরিক অর্থে যে শিল্প ছিল তা হোলো লেখালিখি, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, কলেজ জীবনে বহুবার সে প্রশংসিত হয়েছে, এমনকি M.A করা কালীন রবীন্দ্রাভারতী থেকে তাঁকে ডাকা হতো Debate competition এ অংশ গ্রহণ করতে।
যাক নাচ গানের সে আসর শেষ, গ্রামের লোকেরা জানিনা আজও তাঁদের পাত পড়বে কিনা এ বাড়িতে কিন্ত সমানে জাল দিয়ে মাছ ধরেই চলেছেন। কখনো বাগদা চিংড়ি, চারা পনা, রুই, কাতলা, কেচকি কত ধরণের মাছ একে একে বাড়ির সামনে দালানে এসে রাখছে।
মাছগুলো খাপি খেয়ে চলেছে, মাঝে মাঝে সে মাছগুলো খাপি খেতে খেতে দালান থেকে পরে যাচ্ছে আর পাড়ার কচি কাঁচারা সে মাছ তুলে দিচ্ছে দালানের উপরে। কিছুক্ষন পরে দেখি প্রায় এক কাঁদি কলার ছড়া, গোটা তিরিশেক নারকেল দালানের উপরে রাখলেন। তাতে বুঝলাম আজ সকালের টিফিনটা কলা মুড়ি ও নারকেল। আর প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ এক বা দু গ্লাস করে কচি ডাবের জল। আজ সবাই চলে যাবো বলে গ্রামের লোকজন আমাদের খুশি করার জন্য ব্যস্ত, সমানে বলেই চলেছেন আর কি কখনো হবেন এমুখো, তাই আমরা আমাদের আপ্যায়নের যথাসাধ্য চেষ্টা করছি আপনাদের খুশি করানোর জন্য। “ অতিথি দেবঃ ভব “ এ কথা সত্যি এখানেই প্রযোজ্য।
এবারে স্নানে যাওয়ার পালা, কিন্ত একা নই গ্রামের লোকেদের সাথে একসাথে সেই বড়পুকুরে স্নান, মেয়েরা ছেলেরা সবাই একসাথে। বড়দি স্নান করেনি সেখানে তার বাধা আছে নতুন বৌ হিসেবে, তাই সে শাশুড়ি মায়ের সাথে হেঁসেল সামলাচ্ছে সঙ্গে দুই ননদের নিয়ে। আমরা চলেছি প্রায় দশ বারো জন স্নানে, খাল বিল, আল দিয়ে হেঁটেই চলেছি সে আঁকাবাঁকা পথ।আকাশ মেঘলা বৃষ্টি আসবে মনে হয়। খালের মাঝে মাঝে মাছ ধরার সাঁকো, দেখলাম কিছু কিছু সাঁকো তে মাছ আটকে আছে।
আবার সেই মাছকে খেতে সাপ ও এসেছে, নিরুপায় হয়ে সে সাপ ও আটকে গেছে সেই সাঁকো তে। কিছুদূর হাঁটার পর দেখি এক ছোট্ট মাঠ আর সেই মাঠেই গ্রামের কচিকাচারা কাদা মেখে বসে আছে। নিজেকে আর আটকাতে পারলাম না, মনে পড়ে গেলো আমার শৈশব পাকুড় সেখানে তো একই খেলা খেলতাম, তাই মুহূর্তে ফিরে গিয়ে সারাটা শরীরে কাদা মেখে বসে পড়লাম। “যস্মিন দেশে যদাচার” কথাটা মনে পড়ে নিজেকে উৎসর্গ করলাম বড়দির গ্রামের সাথে।
 দৌঁড়োতে দৌঁড়োতে ঝাঁপ দিলাম পুকুরের জলে আহা কি মধুর সেই অভিজ্ঞতা শুধু খেলা আর খেলা।
ফিরে এলাম বাস্তব জীবনে,এবার তো যেতেই হবে খাওয়া দাওয়া হলেই তৈরী হয়ে ফিরে যাওয়া, তাই মনটা খুবই খারাপ। গ্রামের লোকজন কত আতিথেয়তা আমাদের খেতে দিলেন, পারছি না খেতে সমানে বলেই চলেছেন এতটা রাস্তা যাবেন না খেলে হয়, পৌঁছতে পৌঁছতে তো প্রায় রাত হয়ে যাবে। খাওয়া দাওয়া শেষ, এবারে তৈরী হয়ে বেরোনোর পালা। দিদির শ্বশুর মশায় আমার ছোড়দাকে তো তৈরী হতে দেখে বলেই বসলেন, আজ আর যাওয়া হবে না আকাশ ভালো নেই, যে কোনো সময় বৃষ্টি নামবে, প্রয়োজনে কাল ভোর বেলায় বেরোবেন।
 এ শুনে বড়দি ও বেজায় খুশি, ওমা দেখি সারাটা পাড়ায় সে খবর চাউর হোলো, মুহূর্তে যেখানেই যাই সবাই বলে বসে শুনেছি “আজ আর যাওয়া হোলো নাকো, তা যাবেনই বা কেন এসেছেন কুটুম বাড়ি তা যাবো বললেই হয় নাকি, আসবেন নিজের ইচ্ছায় আর যাবেন আমাদের স্বেচ্ছায় – তা যাই হোক শুনেছি কলকাতায় বে হয়েছে আমাদের দাসবাবুর ছানাটার সাথে কি ভাই মেলা টাকা যৌতুক নিয়েছে কি বলো? আচ্ছা তুমি কে হে? “।কিছু না বলে একটু মিচকি হেঁসে আমি হাঁটতে হাঁটতে দিদির বাড়িতে রওনা দি। বাড়ির জন্য আমারও মন খারাপ করছে দেখতে দেখতে প্রায় সাতদিন পেরিয়ে গেছে। বৃষ্টি নামলো দুপুরের পর থেকে সে বৃষ্টি আর থামার নয় অঝোরে হয়েই চলেছে, যেদিকে তাকাই জল আর জল। সবে খেয়ে দেয়ে উঠেছি দাদার কাকা উনি পূর্ণা কাকা, খুব জোর জোর চীৎকার করেই চলেছেন আর দাদাকে ডাকছেন। মুহূর্তে দেখি গ্রামের বয়স্ক লোক ছেলেছোকরার দল একসাথে জামায়েত। কি হয়েছে জানতে চাওয়াতে তারা বলে এই বাঁধ ভাঙলো বলে তাই সবাই মিলে সে ভাঙা আটকাতে হবে। না আটকাতে পারলে গ্রামের মধ্যেই বাঁধের জল ঢুকে বন্যা হয়ে যাবে।
রাত কাটে বেশ ভয়ে, দাদা ফেরেন প্রায় মাঝরাতে সকাল হতেই চারিদিকে জল আর জল। আমরা কোনোমতে একটু আলুসিদ্ধ ভাতে খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বড়দির মন খুব খারাপ সে বাড়ির দালানের সামনে এসে দাঁড়ালো। লাল পেড়ে শাড়ি মাথা ভর্তি সিঁদুর, মাথায় ঘোমটা একেবারে গ্রামের নববধূর যে সাজ হয় পুরোটাই মিল খুঁজে পেলাম।
 ধীরে ধীরে এগুতে থাকলাম বড় রাস্তার দিকে আর বড়দির ছবিটাও ছোট হতে থাকলো ক্রমশই যত বার মুখ ঘুরিয়ে একটু থমকে দাঁড়িয়েছি বড়দি সমানেই হাত নেড়েই চলেছে। একটা সময় দিদি তার আঁচল দিয়ে হয়তো চোখ মুছতে চাইছে সেটাও বুঝলাম যখন কলাপাতার বনের ফাঁক দিয়ে দিদিকে ঘুরে দেখতে চাইলাম। একটা সময় আর দেখা গেলো না । গ্রামের বেশ কিছু ছেলে আগের থেকেই বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে আমাদের জন্য জায়গা রেখেছে বসার। কারণ গ্রামের বাস এমনিতেই বেশ ভিড় হয়। আবারও বৃষ্টি নামলো কিছুক্ষন পরে বাস ছাড়লো, একটু এগোতেই বাসটা দিদির শ্বশুর বাড়ি পরিষ্কার দেখা যায়। দেখি দিদি তখনও হাত নেড়েই চলেছে। আমি বাসের কাঠের জানালাটা অল্প একটু খুলতেই দিদি বোঝে ওটা ভাইয়ের হাত তাই সজোরে সেও হাত নাড়তে থাকে। মুহূর্তে সে ছবিও হারিয়ে গেলো।
 আমি চুপ করে বসে ভাবছি এখনই আমার মন কেমন করছে বাড়ির জন্য, দিদির তো কত করবে, সে তো সারাটা জীবনের জন্য আমাদের থেকে দূরে চলে গেলো , হয়তো একদিন এ জীবন ও সে মানিয়ে নেবে। মেয়েদের সেই চাপা দুঃখ গুলো কেউ কোনোদিন শুনবে না, জানতেও চাইবে না, আবার পারবেও না। হাসি মনে সে আবার করে, ভোরে উঠে,কাঠের উনোনে আগুনের আঁচ টাকে ওঠাতে ওঠাতে মনের সে দুঃখ যন্ত্রনা গুলো পুড়িয়ে ফেলবে নির্দ্বিধায় আর তৈরী হয়ে উঠবে এক পাকা গৃহিনী হয়ে।
বাবার চোখের জল পরেই চলবে দিদির জন্য আজীবন, আর বড়দি বোলবে সে মন ভোলানো কথা বাবা কিচ্ছু ভেবো না গো আমি দারুন আছি গ্রামে, তোমরা দাদু দিদা হতে চলেছো।পারলে আমায় দেখে যেও আর মা আমি কচুর লতিটা এখন তোমার থেকেও খুব ভালো রাঁধি, তোমরা আসলে খাওয়াবো একেবারে নিজের হাতে।



Comments

sadamata101.blogspot.com

B-47#বিশ্বকর্মা_পূজো

সন্তোষ ঢাকি

B-71#GANESH_PRASADAM. ( গনেশজির ভোগ নিবেদন মোদক ও পূরণ পুলি)