B-48#বড়দির হারিয়ে যাওয়া ( বড়দিদি গল্পের চতুর্থ অধ্যায়)

বড়দির হারিয়ে যাওয়া
আমি তখন বেশ ছোটো বোধকরি পাঁচ বছর হয়তো হবে। ছোটো বেলায় যা দেখতাম নতুন সেটা ছিল বিস্ময়, আর কেবলই  ভ্যাবাচাকা খাওয়া। যেমন ধরুন যে দেশে আমার জন্ম অর্থাৎ পাকুড়, বাড়ির সামনেই ছিল বিশাল  রাজবাড়ী। শিশুমন সারাটাক্ষন একই প্রশ্ন করতো এত বড় রাজবাড়ী অথচ কয়েকজন লোক সে বাড়িতে থাকে, কিভাবে থাকে, রাত হলেই ভয় করে কিনা, আচ্ছা ওদের অনেক জামাকাপড় তাই না?,প্রতিদিন কি খায়, কাজের লোকও তো অনেক?, তাহলে কি সারাক্ষন ঘুমোয় ওরা। এসমস্ত হাবিজাবি প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক করতো পড়তে বসে। আর যেটা খুজতাম নিজেকে নিজের কাছে তা হোলো প্রশ্ন আমাদের কেন ওতো বড় বাড়ি নেই, কেনই বা দুই কামরার ঘরে আমরা এতগুলো লোক থাকি, কাপড় জামা আছে তবে ওদের মত নেই -কেন নেই?। গরিব কাদের বলে যাদের নেই, কেন মানুষ গরিব হয় এ প্রশ্ন মাকে বহুবার জিজ্ঞাসা করেছি শেষে হাঁপিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়তাম সেই রাতে। 
সকালে উঠে জানালা দিয়ে যখনই মোটরের আওয়াজ পেতাম ছুট্টে গিয়ে সে শব্দ মাথার মধ্যে গেঁথে যেত, আর বন্ধুদের সাথে খেলার সময় হতো গাড়ি গাড়ি খেলা। একেবারে মুখে সে শব্দ “ভোঁ ভোঁ ভোঁ “ করে এগিয়ে যেতাম, ধরেই নিতাম আমি গাড়ি আর যে পা দুটো ছুটছে সে আমার মোটর।
 আর বড়বেলায় যা দেখি সেটা বিস্ময় বলবো না লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা আর মনের কাছে অবাক হওয়া, প্রকাশ পাওয়ার বিন্দুমাত্র উপায় নেই, প্রকাশ পেলেই হয়তো বা সে বোকা না হয় একেবারেই গ্রাম্য। আজ এমনই এক বাস্তব কাহিনী কে ঘিরে আমার গল্প “বড়দির হারিয়ে যাওয়া”।
বাবা বদলি হয়েছেন পাকুড় থেকে ঘাটশিলায় মন ভারী খারাপ আর হয়তো কোনোদিন দেখা হবে না বাসু, তারু, বিমল, শঙ্করদা, ঢোরাই মাস্টার, মনা মাস্টার আর আমার শিশুপ্রেমের ভালোবাসার পাত্রী রিকশা চালকের কন্যা চোঁ চোঁর সাথে। ফিরছি কলকাতায় সকাল 6.40মিনিটের কয়লার ইঞ্জিন দানাপুর ফার্স্ট প্যাসেঞ্জের ট্রেনে।
ট্রেনটা যেদিকে যাচ্ছে বসেছি ঠিক তার উল্টো দিকে কারণ তা না হলে যে কয়লার গুঁড়োতে পরনের জামা কাপড়গুলো মুহূর্তে কালো হয়ে যাবে। ট্রেন ছাড়লো আর অবাক হয়ে আমরা চার ভাইবোন জানালার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম  “ঐ তো কালিপুকুর এখানেই তো কাল সকাল অব্দি খেলেছি বল ছোটন, ঠিক এই ট্রেনটাকেই না তুই আর আমি হাত নাড়িয়েছিলাম কাল, আরে মনে নেই কালিপুকুরে যখন মুখ ধুতে এসেছিলাম, তুই তো বললি ভাই দৌড়ে চল , পরে মুখ ধোস, চল আগে টাটা করে দিই”। সেটা আর আসবে না, এজীবনেও আসবে না, কখনোই না, ফিরেই পাবো না। বলতে বলতে চোখে জল গড়িয়ে এল, আর মায়ের সেই ভরসার কোলে মাথা গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লাম, ঘুম ভাঙলো সেই সাঁইথিয়ায় এসে। উঠেই দেখি ছোটনের হাতে খবরের কাগজের ছোট্ট টুকরোতে মিচকানি। ছোটন বললো ভাই খাবি। “খাবো না মানে, সেই পাঁকুড় আর অশ্বথ গাছের নিচে মিচকানি ওয়ালা বসতো আর ধান দিয়ে কত মিচকানি ঘরে আনতাম “। দুপুর দুটোয় এসে পৌঁছলাম জ্যাঠার বাড়িতে সোদপুরে। আজ থাকবো, আমরা কাল চলে যাবো ঘাটশিলাতে বাবা বলছিলো কি একটা ভারী নাম ট্রেনটার মনে নেই। তবে হ্যাঁ স্টেশনটার নাম মনে আছে হাওড়া, ট্রেনটা বিকেলে, সঙ্গে জ্যাঠামশায় যাবেন ছাড়তে।
জ্যাঠা মশায়ের বিশাল অবস্থা, খুব ভালো চাকরি করে, যখনই অফিসে যায় তখনই একটা মোটর আসে নিতে , আর যাওয়ার সময় খুব ভয়ের একটা সাইরেন বাজে, মোটরের উপরে লাল আলো জ্বলে,আওয়াজ টা আমার ভালো লাগেনা, ভয় করে, সে আমি পাকুড়েও দেখেছি, বাবা বলতো মন্ত্রী যাচ্ছে, তখনও ভয় পেতাম। আমাদের সাথে দুজন লোক যাবে, সে জ্যাঠামশায়ের বাগানের কাজ করে মাহু দাদা, আর টুপলাল দাদা, ওরা বিহারী তাই হিন্দি তে কথা বলে। 
দুপুরে তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে বসলাম আমরা চার ভাইবোন আর মা বাবা,  জ্যাঠামশায়ের জিপ গাড়িতে। গাড়িটার পেছনে একটা মাল বোয়ার দু চাকা ওয়ালা কি একটা গাড়ি বেশ লাগানো টুপলালদাদা আর মাহুদাদা আমাদের বোঝাই মালের সাথে সেখানে গিয়ে বসলো।আমার সে কি আনন্দ জিপ গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে “ ভোঁ ভোঁ “ করে পুরোনো স্মৃতি আউড়াচ্ছিলাম, তা শুনে ছোটন বললো ভাই এটা কলকাতা শহর, পাকুড় নয়, লোকে বাজে বোলবে। কিন্তু কে কার কথা শোনে সমানে গাড়িতে বসে হাওড়া পর্যন্ত মুখে ভোঁ ভোঁ করতে করতে হাওড়া পৌঁছে গেলাম। এই প্রথম জিপ গাড়িতে বসলাম।
কি বিশাল হাওড়া স্টেশন যেদিকে তাকাচ্ছি সেদিকে দেখার মত। মাহুদাদা ও টুপলালদাদা সামনে মালগুলো নিয়ে চলেছে, পিছনেই জ্যাঠামনি ও বাবা আর তাদের দুই হাতে ছোটন আমি আর মেজদি। আমাদের পেছনেই মা আর বড়দি। আমি তো হোঁচট খেয়ে কতবার যে পড়লাম ঐ বোরোলিনের একটা বড় লেখা ও আসছে আর  নাচতে নাচতে চলে যাচ্ছে। 
কোথা থেকে যে আসছে আবার কোথায় লুকিয়ে যাচ্ছে সেটা দেখেই বারবার পরে যাচ্ছি। ছোটন তো মেম সাহেব দেখে বলেই ফেলল একেবারে সামনে থেকে ভাই দেখ মেমসাহেব কি ফর্সা, “এ বাবা বুড়ি মেম কিন্ত জামা পড়েছে ছি “। 
আমার জ্যাঠামশায়ের মাথায় টাক, তাই বড়দি ওতো ভিড়ের মধ্যে শুধু জ্যাঠামশায়ের টাক টাই লক্ষ্য করছিলো আর পিছনে পিছনে হাটছিলো সেও কিন্ত সমান তালে দেখেই চলেছে সেই বোরোলিনের লেখা উপরে তাকাতে তাকাতে। একটা সময় বাবা ও জ্যাঠামশায় ঢুকে পড়েছে একটা প্লাটফর্মে, আর জ্যাঠামশায়ের টাক টা সরে গিয়ে প্লাটফর্মের আরেকজন টাকওয়ালা লোক ঢুকে পড়েছে বড়দির নজরে। বড়দি তাকে লক্ষ্য করে এগোতে থাকে আর লোকটা গিয়ে একটা কামড়াতে উঠলে দিদি ও মা পিছন পিছন সেই কামরায় উঠে পরে, গিয়ে দেখে তারা হারিয়ে গেছে সে লোকটা জ্যাঠামশায় নয় অন্য লোক।
আমরা তো না দেখতে পেয়ে সে কি কান্না, এই গেলো মা আর দিদি হারিয়ে আর কোনোদিন ওদের দেখা পাবো না। আমি তো রেগে গিয়ে বাবাকে বলেই ফেললাম এই জন্য বলেছিলাম পাকুড় থেকে না আসতে, এতো লোক এখানে কি করে আসবে কোথায় গেলো। 
জ্যাঠা মশাই চললেন খুঁজতে বেশ কিছুক্ষন পরে দেখি মা আর বড়দিকে নিয়ে আসছে। বাবাতো বড়দি কে টেনে কষিয়ে দিল তাতে বড়দিও কাঁদতে শুরু করলো, চেপে বসলাম ট্রেনে। পরে দিদি বললো যে ট্রেনে ওরা উঠেছিল সেটা দিল্লী যাচ্ছিলো। ইসস যদি খুঁজে না পেতাম। আমাদের ট্রেন ছাড়তেই দেখি কোনো কয়লা বা কু ঝিক ঝিক করছে না ট্রেনটা। 
ট্রেনের বেশ মোটা গদি, কয়লার ট্রেনের মত কাঠের চেয়ার নয়। মনে মনে বেশ আনন্দ হচ্ছিলো ঝাঁ চকচকে ট্রেন লাইন দিয়ে পাখা, সারাটা রাস্তা সে পাখা চলছে।
 গদিতে উঠে দাঁড়াতেই দেখি পাশের কামরার লোকজনকেও দেখতে পাচ্ছিলাম। ট্রেনের লোকজন ও খুব ভালো পোশাক আশাক কয়লার ট্রেনের মত লোকজন নয়। একটু পরেই দেখলাম রাতের খাওয়ার জন্য একজন উর্দি পড়া লোক এল আর বাবাকে বললো রাতে কি খাবেন। আমি তো অবাক বাবাকে বলেই বসলাম এ বাবা এখানে খাওয়ার ও পাওয়া যায় নাকি। এই আমার জীবনে প্রথম ইলেকট্রিক ট্রেনে চাপা 
আর বড়দির হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা যা সারাটা জীবন মনে থাকবে।



Comments

sadamata101.blogspot.com

B-47#বিশ্বকর্মা_পূজো

সন্তোষ ঢাকি

B-71#GANESH_PRASADAM. ( গনেশজির ভোগ নিবেদন মোদক ও পূরণ পুলি)