B-40# বড়দি (প্রথম ভাগ)

                                       বড়দি  (প্রথম ভাগ)
দিদি চলে গেছে, একেবারে ঘুমের দেশে, কিন্তু একটা ভুল হয়ে গেছে যা আর কোনোদিন ও মাথা ঠুকলেও শুধরোবে না। শরৎ বাবুর বড়দিদি,  আমার বড়দি,  এই পৃথিবীর সমস্ত বড়দিদিরা কিন্ত তখনো যেমন পাল্টায়নি আজ ও নয়।   মানুষ গুলোর চিন্তাধারা পাল্টেছে,  যুগ পাল্টেছে,  সময়ের সাথে আমরা আধুনিক হয়েছি, আদবকায়দা পাল্টেছে, বড়দিদিরা ভাই বা বোনকে ক্ষমা করা, তাদের ভুল গুলোকে প্রশ্রয় দেওয়া, আবার পরক্ষনেই সেটা ডেকে শান্ত মনে বুঝিয়ে দেওয়া, একটা মাতৃত্ব পূর্ণ মনোভাব সেই সময়েও ছিল আজ ও আছে, বোধকরি একচুল ও এধার ওধার হয় নি, কোথাও যেন পরিস্থিতির সাথে সমঝোতা করে বুঝিয়ে দেওয়া আমি যে তোর বড়দি।  
                                          ছোটবেলার একটা কথা বেশ মনে পড়ে গেলো, আমি তখন বয়সে বোধহয় চার কি পাঁচ বছরের , সেটা আমার বড়দির থেকে শোনা। বিকেল হয়েছে বড়দি, মেজদি, ছোড়দি ওরা খেলতে যাবে বন্ধুদের সাথে মাঠে চু কিত্ কিত্। মা আমায় চোখে কাজল পড়াচ্ছেন, মাথায় নজর টিপ, মুখে পাউডার, আর আফগান স্নো।  পাউডার দিয়ে আবার টিপের ওপর লেপে দেওয়া, একেবারে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো। চুলে এতো শালিমার তেল যে সেটা গালের পাশ দিয়ে চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ছে, আর মা সমানে আঁচল দিয়ে গাল মুছে দিচ্ছেন।
মুখে একরাশ বিরক্তির ছাপ কারণ চোখে কাজলের জ্বালা, তাই সমানে আরেক হাত দিয়ে চোখের কচলানি, আর রাগে মাথায় প্রলেপ দেওয়া নজর টিপ টা সমানেই মুছে দেওয়া। তার উপর মায়ের আঁচল দিয়ে গরম ভাপ সেটাও আবার চোখের উপর দেওয়া, যাতে চোখ দিয়ে জল পড়াটা বন্ধ করা যায়। আবার করে প্রস্তুতি পর্ব শুরু, এটাও চলতো প্রায় তিন চারবার। সব কিছু শেষ হলে শুরু হত আমার অহেতুক কান্নার পর্ব। সূর্যদেব প্রায় ডুবুডুবু, সব দিদিরা চলে গেছে খেলতে, শুধু মাত্র বড় দি বাদে। কারণ সে যে বড় তাই তার ক্ষেত্রে সিচুয়েশনের কম্প্রোমাইস, যদিও সে ও ছোটো বড়জোর চোদ্দ কি পনেরো। 
অত্যন্ত বিরক্তির ছাপ নিয়ে বড়দি আমায় কোলে নিয়ে একপেশে করে চলতো খেলার মাঠের দিকে। একবার আমায় একটা জায়গায় বসিয়ে দিদি সামনে  কিত্ কিত্ খেলে চলেছে আর আমি বসে দিদিদের খেলা দেখছি, কোথা থেকে একটা শিং ওয়ালা গরু এসে সবে মাত্র আমায় গুঁতোতে এসেছে অমনি দিদি টের পেয়ে গরু টাকে এমন তাড়া দিয়েছে সে পালিয়ে গেছে। আমি বেশ ভয় পেয়ে সমানে কাঁদতে থাকি, তাতে দিদির খেলা পন্ড, সে ছুটতে ছুটতে আমায় কোলে নিয়ে বাড়িমুখী, আর মা কোনো কথা না বোঝার আগেই দিদিকে উত্তম মধ্যম,  এটা হোলো বড়দিদি,  যে জীবনের শত কষ্ট মাথায় নিয়ে তার স্নেহের ভালোবাসার প্রমান দিয়ে চলে ভায়ের বোনের প্রতি আজীবন।
প্রথমেই বলেছি একটা ভুল হয়ে গেছে, আসলে এমনিতেই ক্যান্সার রোগী, ডাক্তার বলেছিলেন কোনো পার্শ্ব  প্রতিক্রিয়া হলেও হতে পারে কিছুদিন পর, সেটা হয়েও ছিল। দিদি কিছুটা হলেও মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিল,  বেশ মাস তিনেক আগের থেকেই সবাইকে ভুল প্রমাণিত করা, অপমান করা, এগুলো প্রায় লেগেই ছিল। আমরা কখনোই কেউ বুঝতে চাই না, বা মনের দিক থেকে মেনে নিতে পারি না আমাদের সম্পর্ককে যে সে মানসিক বিকার গ্রস্ত। কেবলই মনে হয় যে কথাটা বারবার মুখে আসে তাহলে কি সে পাগল?  এই কথাটা ভাবাও কিন্তু আরেকজন কে বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া। আসলে কিন্তু এমনটাই হয়েছিল দিদির ক্ষেত্রে। 
ভাগ্নির বিয়ে হয়েছে দিল্লিতে থাকে, একদিন তাকে দীর্ঘক্ষণ এ ব্যাপারে আলোচনা ও করি, কিন্তু মাঝে মাঝেই সে বলে” মামা তাহলে তুমি বলছো,  মা কি পাগল হয়ে গেছে? “ যদিও তাকে বহুক্ষণ বোঝানোর পরেও সে বোঝে, সেটা হয়তো আমি ভেবেছিলাম, আদতে সেও বুঝতে পারেনি তার মায়ের শেষ পরিণতি এতো তাড়াতাড়ি নেমে আসতে পারে।  দিদি আসলে পুরোটাই অবসাদে চলে গিয়েছিলো  হয়তো কোনো মানসিক ডাক্তারকে দেখালে ভালো হয়ে উঠতে পারতো। এমনিতেই লক ডাউন চলছে,  কোনো ডাক্তারের পরামর্শ যে নেব তার ও উপায় ছিল না। বহু বার ডাক্তারকে ফোন ও করা হয়েছিল, ওঠান নি।  শেষ তিন দিন এতটাই বিমর্ষ আর অবসাদে ছিল যে কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছিলো । রোগ হলে মানুষের পুরো অবয়ব টা যে পাল্টে যায়, আগের চেহারার সাথে কোনোভাবেই মিল খুঁজে পাওয়া যায় না, তা দেখলেই বোঝা যায়।
আজ একান্তে ভাবি নিজের ভুল গুলো ইসস যদি কোনো ডাক্তার পেতাম, হয়তো দিদির আয়ু আরো কিছুদিন থাকতো। দিদির ক্ষেত্রে এতো গুলো কথা এই কারণেই বলতে ইচ্ছে হয় কারণ এতো মানসিক জোর পেতো কোথা থেকে সেটা জানা নেই।  আমায় বহুবার বলেছে সে আমি এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবো না, কমপক্ষে দশটা বছর তো পাবোই আয়ু। বিশ্বাস করুন নিজের দিদি বলে বলছি না, যে কোনো ক্যান্সার রোগীকে  কেমো আর রেডিয়েশন দেওয়ার পর জিজ্ঞেস  করার প্রয়োজন পরে না, কেমন আছেন, তার চোখ মুখ দেখলেই বোঝা যায় সে কি বলতে চায়ছে। দিদির ক্ষেত্রে আমার বিন্দুমাত্র বোঝার উপায় ছিল না, এতো তরতাজা,  জীবন সম্বন্ধে সুষ্ঠ ধারণা একেবারে মৃত্যুর পাড়ে দাঁড়িয়েও যে বলতে পারে, তার জন্য বুকের যথেষ্ট পাটা লাগে। তাই হয়তো দিদি মানসিক অবসাদেই চলে গেলো। একপাড়ে দাঁড়িয়ে যে পরোপাড় কে বলতে পারে দাঁড়াও আমি আসবো, তবে মানসিক ভাবে এখনো প্রস্তুত হয় নি,   তারই প্রস্তুতি চলছে। ওপার টা কেমন গো?  এপারে তো কত মিষ্টি জীবন, টক ও আছে মাঝে মাঝে, কিন্ত আমার ক্ষেত্রে ঝাল একদমই নয়। কাউকে কাউকে তো দেখি তাদের জীবনটা শুধুই ঝাল, তাই অম্বলে জ্বলে মরে, শেষে নিজেরাই চলে যায়। আহা মানুষ জীবন কি অপূর্ব, ছোটবেলায় যখন সবে শিশু বসতে শিখেছি সেই ছড়াটা যে আজ ও বেশ মনে পরে, ঈশ্বরের দেওয়া হাতগুলো ঘোরালেই সেটা পাওয়া যায়। ঘরে এসে কেউ আমায় দেখে এক গাল হাসি দিয়ে ছড়াটা বললেই শুরু করে দিতাম দুলে দুলে, কারণ আমার শিশু মন ও বুঝতো এ এমন এক জীবন যা মন থেকে চাইলেই পাওয়া যায়। 
“হাত ঘোরালেই নাড়ু পাবে, নইলে নাড়ু কোথায় পাবে “
মা লক্ষী পূজো করে আমায় ও বলতেন এই ছড়াটা যখন হাত গুলো ঘোরাতাম সত্যিই সত্যিই দুই হাতে নকুলদানা দিয়ে ভরিয়ে দিতেন। সেই অভ্যাসটা আর কথাগুলো যে আজও মনের অনেক গভীরে রয়ে গেছে। 
                                                     আজ 19 শে জুন 2020 , শুক্রবার, দিদির শ্রাদ্ধ ক্রিয়ায় যোগ দিতে চলেছি, এমনিতেই দিদির মারা যাওয়ার দিন যেতেও পারিনি, কোরোনার জন্য বাধা ছিল প্রশাসনিক ভাবে।দিদিকে দেখেছি ভিডিওতে, দিদির চিতা সাজানো হয়েছে, আগুন দেওয়ার সাথে সাথে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম,  আমার একান্ন বছরের পাকুড় থেকে ঘাটশিলার সম্পর্ক যে সেদিনের 9ই জুন 2020তে কাঠ থেকে ভুসো কালি হয়ে নিমেষেই পঞ্চ ভূতে বিলীন হয়ে গিয়েছিলো। ব্যস একান্নটা বছর নিমেষেই চার ঘন্টায় উবে গেলো। 
“ সে ঢেউয়ের মত ভেসে গেছে, চাঁদের আলোর দেশে গেছে ,
যেখান দিয়ে হেসে গেছে,  হাসি তার রেখে গেছে রে,  
মনে হোলো আঁখির কোণে আমায় যেন ডেকে গেছে সে  
আমি কোথায় যাবো কোথায় যাবো ভাবতেছি তাই একলা বসে.... “

  তাই  কোলকাতা থেকে চলেছি নিজের গাড়ি নিয়ে সঙ্গে স্ত্রী কন্যা, আমার মেজদিদি ও তার মেয়েকে নিয়ে। এমনিতেই বেশ কড়াকড়ি স্টিয়ারিং এ হাত দিতেই মনে পড়ে গেলো যেখানে যাচ্ছি সেখানে  আমার ছোটবেলা কেটেছে,   এবারে ঘুরতে নয়,  দিদির কাজে ঘাটশিলাতে । আর হয়তো কোনোদিন যাওয়া হবে না, একটা টান তো ছিলই ছোটবেলার টান, দিদির টান,  সেই শেষ সম্বল টুকু, সুতোর টান টাও ছিঁড়ে গেছে। দাদা হয়তো  থাকবেন সেখানে বেশ কিছুদিন কিছুটা বছর তারপর কালের অমোঘ নিয়মে জীবনের শেষ সময়টা সুদূর দিল্লিতে গিয়ে মেয়ের কাছে থাকবে, দাদার ও সাজানো বাগান যে শুকিয়ে গেলো। সাজাতে চাইলেও যে কোনোদিন আর মন আর শরীরের দিক থেকে পারবে না, সেটা সাই দেবে না। বড়দি, দাদার সংসার জীবনের ইতি টেনে চলে গেছে , পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে ঘাটশিলায়। একদিকে যজ্ঞ, আরেকদিকে মন্ত্র, দিদি ছবি হয়ে বসে আছে,ফুলের ভারে মুখটা ঢেকে গিয়েছিলো, আমি ফুলের মালাটা সরাতেই মনে হোলো দিদি বলে উঠলো এতো দেরী কেন ভাই রাস্তায় তোদের কষ্ট হয়নি তো?  বোস একটু জল খা, তারপর চা দিচ্ছে, আমি খুব ভালো আছি, এখানে আর কোনো কষ্ট নেই জানিস তো,   ভাই তোরা সবাই ভালো থাকিস, জীবনটাকে মেনে নিতে হয়, দুঃখটাকে নয়।
শেষ জীবনের কয়েকটা দিন দিদি একটি বাচ্চাকে অর্থাৎ কাজের মাসির ছোট্ট ছেলেকে নাতির আসন দেয়, মাঝে মাঝে আমায় ফোন করতো আর বলতো এই দেখ আমার নাতিকে, যাক সে শখ ও সে মিটিয়ে নিয়েছিল। 
ভারী অদ্ভুত লাগে দিদির কাজের দিন সে ছোট্ট বাচ্চাটি কথা না বলতে পারলেও সমানে খুঁজে চলেছিল তার দিদাকে, হয়তো কেন সেও মনের একটা টান অনুভব করতো।

তখন আমি ক্লাস ইলেভেনে পড়ি, দিদির বিয়ে হয় আমায়  স্কুলের  সময় পড়াতেন প্রাইভেট টিউটরের সাথে, এক অর্থে প্রেমের বিয়ে। দাদার আদি বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরে, বাবার ঘোর আপত্তি  ছিল এ বিয়েতে, কিন্ত দিদির একান্ত ইচ্ছে আর বাবা মায়ের অনীহায় এই বিয়ে সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশ থেকে মেজ জ্যেঠামশাই এলেন একেবারে স্বশরীরে ছেলের বাড়ি দেখার জন্যে, সঙ্গে আমার বাবা ও মেজদি গেলেন, ঘুরে এসে এক গোল টেবিল বৈঠক বসলো বলা চলে সেজো জ্যেঠামশায়ের বাড়িতে একেবারে সামনের ঘরটাই ওটাকে আমরা গোলঘর বলতাম। সেজো জ্যেঠামশায় থাকেন ঠিক আমাদের বাড়ির কাছে মিনিট দুয়েক হাঁটা পথ। যেহেতু বাংলাদেশের একটা আদব কায়দা ছিল তাই সেজো জ্যেঠামশায় ও তাঁর বাড়িটা বানিয়েছিলেন ঐ অনেকটা একই ধাঁচে। বলা দরকার আমাদের ছোটদের কিন্তু সে ঘরে ঢোকার বিন্দুমাত্র অধিকার ছিল না তাই কান পেতে শুনতাম, শুধু একটাই কারণে বড়দিদির বিয়েটা কি হচ্ছে, না কি হচ্ছে না?
আসি সে কথায় কেমন ছিল সে বিয়ে, বাবার কি কি স্বপ্ন ছিল সেই বিয়ে নিয়ে বড় মেয়ে বলে কথা। আসছি পরের অধ্যায়ে বিয়ের দিন, গ্রামের বরযাত্রী মানসিক অবস্থা, আর আমার বড়দিদির একেবারে বলা চলে গ্রাম্য বধূর বেশে শ্বশুর বাড়িযাত্রা।


Comments

sadamata101.blogspot.com

B-47#বিশ্বকর্মা_পূজো

সন্তোষ ঢাকি

B-71#GANESH_PRASADAM. ( গনেশজির ভোগ নিবেদন মোদক ও পূরণ পুলি)