B-18 #MAN_OF_ INNOCENCE. নির্লিপ্ত সোনাদা

  নির্লিপ্ত সোনাদা 


জীবন সম্বন্ধে এক উদাসীন নির্লিপ্ত ব্যক্তিত্বের নাম আমার সোনা দা। জীবনের নানান নেতিবাচক পরিস্থিতি তাঁকে উদাসীন হতে বাধ্য করেছে, একেবারে প্রতিবাদ ছাড়াই । অনেক ঝড় ঝাপটা তাঁর জীবনে বয়ে গেছে, এ যেন এক মাঝ  সমুদ্রে আশা এক বিশাল ঝড়ের ঝাপটায়  যখনই জাহাজ অতল সমুদ্রে তলিয়ে গেছে , আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছে সব শেষ, কোথাও কোনো প্রাণের আশা নেই, আর থাকবেই বা কি করে, সেটা ভাবতে পারা টা ও যেন কল্পনা শক্তির বাইরে।কিন্ত তখনই হঠাৎ করে নাবিক ফিরে এসে বলে হ্যাঁ আমি আছি, আমি জীবিত।হ্যাঁ,ঠিকই বলছি, এতটুকু বানিয়ে বলছি না বিশ্বাস বা ভরসা পুরোপুরি করতে পারেন। সব কিছু শেষ হয়ে গেলেও "আমি আজও জীবিত", ইনিই হলেন বাস্তব গল্পের নায়ক আমার নাবিক নির্লিপ্ত সোনাদা । সোনাদার নানান কাহিনী একেবারে ছোটো থেকে বড় হয়ে বেড়ে ওঠা, প্রতিটি ধাপেই যেন আঘাতের পর আঘাত, নিজের সাথে সংঘাত, এত প্রতিকূলতার জীবন ও যে একটা মানুষের হতে পারে তা যেন অবিশ্বাস্য, এ যেন প্রত্যেকটা কাহিনী মনে হয় কেউ তুলি দিয়ে লিখে রেখেছেন আগের থেকেই, বিশাল ক্যানভাসে এক গল্পের আকারে যেটা সমানে ঘটেই চলেছে সোনাদার জীবন পঞ্জিকায়।
সোনাদা আমার মামার বাড়ির একজন দায়িত্ব পূর্ণ care taker, আমি তাঁকে একজন নিঃস্বার্থ যত্নবান অবিভাবক হিসেবে দেখে এসেছি ছোটো থেকেই, তাঁর আদর্শ আমাকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবান হতে শিখিয়েছে, যখনই দেখেছি শ্রদ্ধায়  মাথা নত হয়েছে । তাঁর জীবনের নানান ঘটনার সামান্য কিছু না জানালেই নয় , তাই তাঁকে নিয়েই কৌতূহল বশত আমার এই লেখা।

আমার মায়ের ছোটবেলাটা বর্মাতে কেটেছে, বর্তমানে যেটা রেঙ্গুন। সোনাদা ছিল আমার মায়েদের পাশের বাড়ি এক অর্থে প্রতিবেশী। তাঁদের বেশ অবস্থাসম্পন্ন পরিবার ছিল বার্মাতে,আর উনি ছিলেন মা বাবার একমাত্র ছেলে যদিও আরেক বোন ছিল সে সম্বন্ধে আমার কিঞ্চিৎ জানা। পঞ্চাশের  দশক বোধহয়, তখন বার্মায় প্লেগ মাঝেমধ্যেই   মহামারী আকার ধারণ করতো , আর সেই সময় সোনাদার মা ও বাবা দুজনেই আক্রান্ত হলেন প্লেগে। সোনাদার মা বাবাকে দীর্ঘ লড়াইয়ের পরও বাঁচানো যায় নি। মায়ের থেকে শোনা, সোনাদার মা ও বাবা দুজনেই নাকি পাঁচ দিনের ব্যবধানে চলে গিয়েছিলেন। মা বলেছিলেন " সোনা একেবারে চুপ করে, কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে অবাক হয়ে তাঁদের শেষ বিদায় জানিয়েছিল "।
একাকীত্ব জীবন শুরু হয়, নিজের সাথে নিজের লড়াই, সোনাদার তখন বয়স বোধহয় দশ কি বারো একেবারেই নাবালক সে। তাই দাদু যথেষ্ট খেয়াল রাখতেন তাঁর,আর পরবর্তী জীবনটা শুরু হয় দাদুর কাছেই  ম্যান্ডেলে শহরে। এমনিতেই সোনাদা বেশ মনমরা হয়ে থাকতেন মা বাবা বিয়োগের পর,ছোটো বেলায় মা বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়া এক শিশু কতই বা বুদ্ধি হয়েছে তাঁর, জীবনে যাঁর ক্ষেত্রে এসেছে একমাত্র হয়তো সেই বলতে পারে। প্রতিটা মুহূর্তে সে হাতছানি দেই একটা আশ্রয়, একটা ভালোবাসা, যাকে ধরে সে বাকি জীবনটা এগিয়ে যেতে পারে। কিন্ত বাস্তবে হয় ঠিক তার উল্টো একটা দয়ার পাত্র, আবার কারো কারো ক্ষেত্রে সেটা এতটাই অভিভাবত্ব ফলে যে ধরেই নেই যে মা বাবা নেই বলে সে বিগড়ে গেছে। ঠিক এমনটাই হয়েছিল আমার ছোট্টবেলার সোনাদার উপর।
 এক বিকেলের ঘটনা,পাড়ার এক মহিলা তাঁর বাচ্চাকে সোনাদার হাতে দেন পার্কে নিয়ে ঘোরানোর উদ্দেশ্যে, এতে সোনাদার ও মন ভালো লাগবে বাচ্চার সাথে খেলা করতে আর বাচ্চাটির ও ঘোরা হবে এই ভেবে।
বলা বাহুল্য রেঙ্গুন হোলো সোনার দেশ সেখানে লোকজনের সোনা পরে ঘোরার একটা বেশ চল আছে, দিনে রাতে সবসময় তারা সোনা পড়তেন বা এখনো পড়েন সে দেশে চোরের উপদ্রব টা অনেকাংশে তুলনামূলক ভাবে কম। যাক সে সব কথা, যে বাচ্চাটি কে নিয়ে সোনাদা পার্কে যান তার গলায় একটা বেশ মোটা সোনার চেন ছিল, কোনো কারণে সেটা খেলতে গিয়ে সেখানেই হারিয়ে যায়, বা কোনো কারণে সেটা গলার থেকে খুলে পরে যায়।  সোনাদা যখন বাড়িতে এসে বাচ্চাটিকে তাঁর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেন, মা বাচ্চাটির গলার চেনটিকে  দেখতে না পাওয়ায় সোনাদার উপর প্রথমে রাগারাগি, পরে গালাগালি শুরু করেন , এখানেই শেষ নয় পাড়ার লোকজন ডেকে শায়েস্তা স্বরূপ মারধোর ও করেন পাছে যদি সোনাদা স্বীকার করেন। মা বাপ্ মরা ছেলেটার পাশে দাঁড়ানোর মত সেদিন কোনো লোক ছিল না , মারের আঘাত এতটাই গুরুতর যে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় ও শেষমেশ উনি একেবারেই কোমায় চলে যান।
 শুনেছি বার্মায় চুরি হোলো এমন এক শাস্তি সেটা প্রায় মৃত্যুদণ্ডের কাছাকাছি, হয়তো উনি সেই কারণেই প্রশাসনের সাহায্য পাননি। চিকিৎসার অর্থ যোগাতে এমতাবস্থায় দাদু কিছুদিন তাঁর চিকিৎসার ব্যয় ভার নেন, ততদিনে উনার শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হয়। উপায়ান্ত না দেখে দাদু তাঁর পাড়ার লোকজন ডেকে, হাসপাতালের খরচ চালানোর অর্থ হিসেবে সোনাদার পৈতৃক ভিটে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন ও সেটা করেও ফেলেন।
যাক সোনাদার সুস্থ হতে প্রায় মাস ছয়েকের উপর হয়ে যায়। হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে সোনাদাকে দাদু আশ্রয় দেন নিজের বাড়িতে। এরই মধ্যে দাদু তাঁর বার্মার ব্যবসা  বড় ছেলের নামে করে, সোনাদাকে নিয়ে একেবারে সরাসরি কলকাতায় আসেন, ও দক্ষিনেশ্বরে একটা বাড়ি কিনে ওষুদের ব্যবসা শুরু করে দেন পুরোদমে বাগড়ি মার্কেটে।যেহেতু দাদু বার্মায় একই ব্যবসা করতেন অর্থাৎ ওষুধের , কিন্তু সোনাদাকে সে ব্যবসায় কোনোদিন নিয়োগ করেন নি, হয়তো বা ভবিষ্যৎ চিন্তা করে, তাই সোনাদা বাড়ির তদারকির কাজই করতেন আর বিশেষ কিছু নয় । সোনাদার অলিখিত care taker জীবন শুরু হয় দাদুর সাথে ছেলের মতন কিন্ত ছেলে নয়। যেহেতু ব্যবসায় সোনাদা কোনোভাবেই স্থান পাননি, তাই দক্ষিনেশ্বরে বাড়ির ঠিক কাছেই একটা আর্মি কেম্প এ মালির কাজ পান। দিনের বেলায় ক্যাম্প এ ফরমাসি খাটতেন, আর রাতে দাদুর সাথে থাকতেন।
এভাবে দীর্ঘদিন চলার পরে আমার দাদু তিন মামাকে কলকাতায় নিয়ে আসেন ব্যবসার কাজে, আর সোনাদার বয়স হওয়াতে উনাকে বিয়ে দেন নিজের পয়সায় এতটুকুই তাঁর প্রতি কর্তব্য করেন। সোনাদার ও বছর পাঁচ ছয়েকের মধ্যে দুটি কন্যা সন্তান হয়। জীবন তার স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পেয়েছে, গতিময় ও হয়েছে অনেকটা, একটা সুখের সংসার চলছে দুলকি চালে যেখানে অভাব আছে আবার বোঝাপড়াও আছে হয়তো বা ষোলোআনা ।
 দ্বিতীয় ধাক্কা এসেছে বেশ কিছুদিন পরেই, একদিন উনার স্ত্রী তাঁর দুই কন্যা সন্তান কে নিয়ে বাপের বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কয়েকদিনের জন্য, যেহেতু বহুকাল যাওয়া হয়ে ওঠেনি, তাই সোনাদাও তাতে  তাঁর সম্মতি দেন। “প্রেম এসেছিলো একদিন নীরবে “ কথাটা সোনাদার স্ত্রীর জন্য প্রযোজ্য হোলো নীরবে । এলাকার একজনের সাথে প্রেম আর সেখান থেকেই শুরু তাঁর স্ত্রীর নতুন জীবন গড়ার সাময়িক পথ চলা , তাই সে প্রেমিকের হাত ধরে চলে যায়  সুদূর দিল্লীতে । দিল্লী পৌঁছতেই দুই কন্যাকে স্টেশনে রেখে মা চম্পট দেয় স্বামীর ঘরে।

ইতিমধ্যেই মেয়েরা অল্পবিস্তর বড় হয়ে গেছে, তাই পুলিশের তত্ত্বাবধানে খবরও পৌঁছয় কলকাতায়, এরই মধ্যে এক হিতাকাঙ্খী লোকের সহযোগিতায় মেয়ে দুটো স্থান পায় দিল্লী কালীবাড়িতে। ততক্ষনে সোনাদা সেখানে পৌঁছয়, মেয়ে দুটোকে কোনো ভাবে উদ্ধার করে যথার্থ  পিতৃপরিচয় দিয়ে,আবার করে সংগ্রামের পথে যুদ্ধ  শুরু হয় নিজের সাথে একেবারে নতুন ভাবে । জীবন যেন একটু ভালোর মুখ দেখতে না দেখতেই সোনাদাকে আবার ফিরিয়ে দেয় এক কঠিন বাস্তবতার সাথে লড়াই করতে, সমস্ত ভবিতব্য সে মেনে নেয় এটাই বুঝি বিধির বিধান।কিন্তু কোনোখানেই উনাকে বিচলিত করে না, একেবারে নির্লিপ্ত আপনমনা সোনাদা। মেয়েরাও বড় হতে থাকে এক আশ্রমে এভাবে সোনাদার এক গদাই লস্করি চালে জীবন টা চলতে থাকে বেশ বছর দশেক কিংবা তার কিছু বেশি ।
একে তো সেই ছোট থেকেই জীবনের চলার পথে শুধুই কালো ছায়া, নিজের ছায়া কে দেখলেও হয়তো সে ভয় পায়  মনে মনে, আবারও কালো দাগ নেমে আসে, তাঁর স্ত্রী ফিরে আসেন, এক দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে, যদিও সোনাদা স্বীকার করে নেন তাঁকে, আর বছর খানেক সেবা করার পর স্ত্রী বিয়োগ হয়ে  যায় । শ্বশুর বাড়ির দায়িত্ব,শাশুড়ির সেবা যত্ন,আমৃত্যু পর্যন্ত করেছেন এই সোনাদা, একেবারে নিঃস্বার্থ ভাবে কোনো কিছুই পাওয়ার আশায় নয় , অর্থাৎ সম্পত্তি  বা বিষয় আসয় কিছুতেই তাঁর লোভ ছিল না,শুধুমাত্র যেটা ছিল সেটা মূল্যবোধ আর এক গুরু দায়িত্ব পালন ।
জীবনে একটা মানুষের আরো কত অপমানিত বা ছোটো হতে হয়, তাও আবার কোনো অনাত্মীয় নয়  নিজের সম্পর্কের কাছে, সেটা এহেন সোনাদার মত মানুষ না হলে বোঝার বা উপলব্ধি করার  উপায় নেই।
 সুধী পাঠকবৃন্দ এবারে যে ঘটনাটা বলবো সেটা হয়তো আপনাদেরও চোখের জল ফেলতে বাধ্য করবে, আশাকরি পুরোটা হয়তো বা অনেকেই পড়তে পারবেন না একটু থমকে গিয়ে ভাববেন বা হয়তো ইতি টানবেন মনে মনে , একটা  কলুষিত জীবন যাঁর পূর্বজন্মের পাপের ফল বুঝি ভোগ করছেন । জীবন সম্বন্ধে সোনাদার নিজের কি ভাব একটু জানতে ইচ্ছে করে না। আমরা তো এতটুকু তেঁতো হলেই সংসার জীবন কে থেঁতো করে দি, রাগ আর অভিমানে, এমনকি বেছে নি শেষ পরিণতি কে । সোনাদা  জীবনটাতে না পেলেন মিষ্টি, না টক, শুধুই ঝাল আর ঝাল।
জীবনের অনেকটা বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর এতদিনে সোনাদার মেয়েরা বেশ বড় হয়েছে, বড়  মেয়ে একটি multinational organisation এ চাকুরীরতা, আরেকজন কলকাতায় চাকরি। সোনাদা থাকেন দক্ষিনেশ্বরের বাড়িতে সেই দাদুর আমল থেকে।বাড়িটি প্রায় ভগ্নদশা সেখানে আমার মামিমা কে নিয়ে একা দেখভাল করেন,আর মামীমাকে সোনাদা মায়ের স্থান দেন। প্রসঙ্গত বলি আমার মামা বাড়িটা একেবারেই লকেট চ্যাটার্জীর উল্টো দিকের বাড়ি, তাই লকেটের সাথে একেবারেই ছোটবেলার থেকে আমারও ভালোই বন্ধুত্ব ছিল , আজ সে সেলিব্রিটি দেখা হলে হয়তো সে চিনতেও পারবে না এটাই স্বাভাবিক । যাক সে কথা, সোনাদা ইতিমধ্যে প্রমোশন হয়ে আর্মিতে সুবেদার হয়ে রিটায়ার করেছেন , তাও ভালোবাসার খাতিরে সেখানে গিয়ে টুকটাক কাজ ও করেন, আর যৎসামান্য টাকা ও পান। নিজের রিটায়ারমেন্ট এর  টাকা দিয়ে দুই মেয়েকে বিয়েও দেন এক স্বনাম ধন্য বাড়িতে দিল্লীতে, শ্বশুর মশাই কর্নেল, আর্মির ডাক্তার, থাকেন heart of the city cannught place delhi ।
 উনার দুই ছেলে একজন ব্যাংকে অফ বারোদায় ম্যানেজার আর আরেকজন ব্যবসায়ী। সোনাদা একই সাথে দুই মেয়েকে, দুই ছেলের সাথে বিয়ে দেন। জীবনের বাকিটা সময় একেবারে মামিমার সেবায় ব্রতী হন, রোজ খুব সকালে উঠে গঙ্গায় স্নান করে, মাকালীর কাছে পূজো দিয়ে, পুজোর ফুল আর প্রসাদ নিয়ে মামীর কপালে ঠেকান, আর প্রত্যেকদিন মামীকে ঘুম থেকে ওঠান, এই ছিল সোনাদার নিত্য নৈমিত্তিক জীবন পঞ্জী। মাঝে মাঝে দিল্লী যান, ইতিমধ্যে দুই মেয়ের ঘরে নাতি নাতনিও  হয় যখনই যান বাচ্চাদের জন্য যেটুকু কর্তব্য আর সামর্থ সেটুকুও মেটান, মনের মধ্যে কোথাও নিজেকে ছোটো ভাবতেন কারণ মেয়েদের শ্বশুর বাড়ি ছিল উচ্চশিক্ষিত ও পয়সাওয়ালা, তাই নিজেকে কোনোভাবেই মানাতে পারতেন না সে বাড়িতে গিয়ে , তাই দু একদিন থেকে কলকাতায় ফিরে আসতেন। মেয়ের শ্বশুরমশাই ছিলেন এক দুঃশ্চরিত্র ও পিশাচ।
সেটা কিন্তু কোনো কালেই মেয়েরা বাপকে খোলসা করে বলতে পারেননি, বলবেই বা কি করে কারণ একে তো বাপ্ নামক মানুষটি আজন্ম দুঃখী সে সব আর বলে লাভ কি। এব্যাপারে সোনাদাও কানাঘুসো শুনেছেন একটু আধটু কিন্তু বিশেষ একটা আমল দেননি । সোনাদার ছোটো মেয়ে নয়ডায় থাকতো জামাইয়ের সাথে, একটা সময় জামাই  ট্রান্সফার হয় দিল্লীতে, তাই সস্ত্রীক দিল্লিতে নিজের বাড়িতে থাকে। বড়মেয়ে কখনোই চাই তো না বোন তার সঙ্গে থাকুক তাও আবার একই বাড়িতে, এতে দুই বোনের মতান্তর ছিল দীর্ঘদিনের সেটা আবার সোনাদার হস্তক্ষেপে মিলমিশও হয়। হাটের হাঁড়ি ভাঙলো কিছুদিনের মধ্যেই, সেটা হোলো ছোটো বোন লক্ষ্য করে দিদিকে প্রায়শই শ্বশুর মশায়ের ঘরে যেতে, তাও আবার বেশি রাতে, আর না আসলেই শ্বশুরের চীৎকার আর অশান্তি। এই চিৎকারের সুরাহা করতে ছোটো বোন একদিন গোটা রাত জেগে থাকে আসল সত্যিটা জানার জন্য, এক জোর করে দিদির সাথে শ্বশুরমশায়ের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ধরা দেয় বোনের চোখে।
এভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর সে দিদিকে জিজ্ঞাসা ও করে এই সম্পর্কের কথা। দিদি স্বীকার করে, এতে দিদির স্বামীর ও মত  আছে, কারণ বাবার বিপুল সম্পত্তি থেকে তা না হলে সে বঞ্চিত হবে, আর দিদির ভয় একটাই যে শ্বশুর মশাই সমানে বলতেন না আসলেই তার সন্তানকে সে মেরে ফেলবে। নয়ডার সেই নয়ডার পাষণ্ড নিঠারি  কে মনে পরে, যে প্রচুর বাচ্চাদের মেরে বাড়ির নিচে পুঁতে রাখতো, এমনকি শশুরমশাই তার ও হুমকি দিত বৌমাকে।
বড় মেয়ে বহুবার ভেবেছে থানা পুলিশ করবে বলে, পরক্ষনেই ভাবে ওসব আমাদের মত মেয়েদের পোষায় না, অর্থাৎ প্রতিবাদ,একে তো টাকার জোর নেই, আবার বাবার কাছে  যাওয়াও চলবে না কারণ বাবার নিজেরেই চলে না সে চিন্তা করাটাও বৃথা, এভাবেই চলতো প্রতিনিয়ত মনের সাথে লড়াই, আর শ্বশুরের শারীরিক অত্যাচার। এতদিনে ছোটো বোন বুঝে গেছে কেন দিদি তাঁকে এবাড়িতে একসাথে থাকতে বারণ করেছিলো, কোনো মেয়েই চাই না তার সাথে যে অন্যায় হয়ে চলেছে সমানে সেই একই অন্যায় তার বোনের সাথে বা অন্য কোনো মেয়ের সাথে হোক। দিদির সাথে সে অত্যাচারও শুরু হয় কিছুদিনের মধ্যে ছোটবোনকে পাওয়ার, সে পাওয়া যদিও হয়ে ওঠেনি শ্বশুরের। এমতাবস্থায় শ্বশুর এক ফাঁদ তৈরী করে মনে মনে আর সকলের সাথে এতই সুব্যবহার শুরু করেন , বিশেষত বৌমাদের উপর তারা ধরেই নেন উনি উনার ভুল বুঝতে পেরেছেন এমনিতেই ষাটের কাছাকাছি বয়স হয়েছে। 
2016 সাল ঠিক দুর্গোপূজোর আগে শ্বশুরমশায়ের ইচ্ছে হোলো রাঁচিতে উনাদের একটা আদি বাড়ি আছে,সেখানে সবাই মিলে গিয়ে থাকবেন বেশ ধুমধাম করে দুর্গাপুজো কাটাবেন।
এদিকে সোনাদার বড় মেয়ে দিল্লি থেকে কলকাতায় এসেছে দুদিনের জন্য অফিসের কাজে, তাই ছেলেকে বোনের কাছে রেখে, বাবার সাথে দেখা করে, বাবাকে পুজোর কাপড় চোপড় দিয়ে দিল্লী ফেরার মনস্থির করে। হঠাৎ বোন ফোন করে জানায় দিদি তুই পারলে রাঁচিতে আয় আমরা দশমীর পরের দিনই দিল্লী ফেরত যাবো, এই বোনের সাথে শেষ কথা। নবমীর রাতে সেই নৃশংস কর্নেল খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে সকলকে চিরনিদ্রায় শায়িত করেন। জীবনের শেষ নির্লজ্জ  অভিলাষা টিও মিটিয়ে ফেলেন ছোটো বৌয়ের সাথে যখন সে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।পরের দিন সকালে একসাথে চারজনের মৃতদেহ উদ্ধার করে স্থানীয় পুলিশ।
কর্নেল জীবিত সে নিজেও ছুরিকাঘাত করে তল পেটের এমন এক জায়গায় যাতে কোনো ভাবেই মৃত্যু অন্তত সম্ভব নয় যেহেতু সে ডাক্তার সে সব বোঝে বলেই এই সিদ্ধান্ত। শুনেছি রাঁচির লোকাল news channel থেকে শুরু করে সমস্ত চ্যানেলে এই মর্মান্তিক খবর দেখানো হয়। জানিনা পুলিশ কে সে কি ফাঁদের গল্প শোনায়, কিন্তু পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে এত টুকু খবরও পাওয়া যায় নি ।এদিকে সোনাদার মেয়ে যথাসময়ে দিল্লিতে পৌঁছয় কিন্ত কেউ ফোন না ধরায় এখবর সে সোনাদাকে জানায় । সোনাদা স্বশরীরে রাঁচিতে পৌঁছলে আসল সত্যতা জানতে পারেন। বহু থানা পুলিশ করেও উপযুক্ত বিচার পেলো না সোনাদা। বহু সংবাদ মাধ্যমের কাছে পৌঁছতে চেয়েছিলেন যারা তাঁকে আশ্বাস দেন, কিন্ত সেগুড়ে বালি।  এতবড় ধাক্কা পেয়ে ও মানুষটি আজও মন্দিরে মায়ের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। ঈশ্বর বোধহয় তাকেই বেছে নেন যাঁর মারফৎ সৃষ্টি করতে চান নজির, আজকের দিনে এই ধরণের মানুষ পাওয়া অতি বিরল। 
শেষ ধাক্কা বলা ভুল হবে কিনা জানিনা, আরও কত ধাক্কা অপেক্ষায় আছে সোনাদার জীবনে যেহেতু এখনো সে বেঁচে, ধাক্কা খেতে খেতে তো জীবনের শেষ ধাপে তো এসে পৌঁছেছেন। গত 18ই জুলাই 2020 আমার মামিমা স্বর্গলোকে যাত্রা করেন, নিজেরই বাসভবনে। মৃত্যুর সময় সোনাদা তুলসী পাতা ও মুখে জল দিয়ে মামীকে শেষ বিদায় জানান। মৃত্যুর খবর পেয়ে যারা আমাদের আত্মীয় অর্থাৎ মামাতো দাদারা দিদিরা আসেন ঠিকই, কিন্ত শেষকৃত্যের সাক্ষী স্বরূপ নয়, আসেন ভাগ বাটোয়ারা করতে, এখানেও সোনাদা বঞ্চিত এতটুকু অংশ সে পাইনি, উপরন্তু বহু উপহাস আর অপমানিত হয়েছেন অনুরোধ করাতে। যাক মৃত্যু সংবাদ আমি পাই বহু পরে কারণ আমাকে জানাতেও তারা কুন্ঠা বোধ করেন পাছে আমি ভাগ চাই। সোনাদা চেয়েছিলেন অন্তত পক্ষে ভিটেমাটির সামান্য কিছু অংশ যেন সে পায় । রবীন্দ্রনাথের পুরাতন ভৃত্য বা দুই বিঘা জমি মনে পরে?যে সারাটা জীবন উৎসর্গ করলো অন্যের জন্য, এতটুকুও জমি সে পেলো না শেষ বয়সে এসে, উপরন্তু তাঁকে ঠকিয়ে, প্রতারণা করে দাদারা সমস্ত কাঙালের ধন হস্তগত করলো একেবারে নির্দ্বিধায় । সোনাদা সমস্ত  অপমান মাথায় পেতে বেরিয়ে এলেন, চাইলে উনি পারতেন লকেটকে সমস্তটাই অভিযোগ করতে, যেহেতু সে MP, আবার সিনেমা জগতের কাছে একটা পরিচিত নাম লকেট চ্যাটার্জী। ছোটবেলায় এই সোনাদা বহুবার লকেট কে নিয়ে গেছেন মমতা শঙ্করের কাছে নাচ শেখাতে সেটা আমাদের ও অজানা নয়,যেখান থেকে তার জীবনের শুরু।
এতদিন বেশ হজম করে গেছি, কারণ ওবাড়িতে আমারও ভাগ আছে, এবারে বুঝি সময় এসেছে লড়াই করার নিজের পাওনা টুকু আদায় কাচ কলায় ফিরে পাওয়ার সেটা আমার নিজের জন্য নয় কোনোভাবেই পেয়ে সোনাদাকে পাইয়ে দেওয়ার জন্য লড়াই । যাঁদের এতটুকু মায়া মমতা নেই, সহানুভূতি নেই তাঁরা কিসের আমার আত্মীয় পরিজন , প্রয়োজনে মানবাধিকার সংস্থার কাছে দ্বারস্থ হবো দেখি কতদিনে এরা সম্বিত ফিরে পায় ।
সব সোনা বোধহয় সোনা হয় না, ঈশ্বর খাদ দিয়ে পাঠান হয়তো পুরোদস্তুর সে খাদ ভালো আছি ভালো থাকবো না পাওয়ার খাদ, মাথা ঠুকলেও পাওয়া সম্ভব নয় , যেটা সম্ভবত শুধুই ধৈর্য্যের আর পরিস্থিতিকে মেনে নেওয়া । সোনাদার জীবন কাহিনী মোটেই সোনার নয়, হয়তো বা কাঁসার তাই শুধুই রূপ পেয়েছে সোনার, বাকিটা খাদরুপী বহুরূপী মানুষগুলো ছিনিয়ে নিয়েছে।  কার জয় জানা নেই সোনাদার তো নয় , তাহলে কি শুধুই পিশাচের জয় হয়, এর উত্তর আমার অন্তত জানা নেই আপনাদের উপরেই ছাড়লাম জানিনা জীবন যুদ্ধে সোনাদারা সুবিচার পাবে কিনা পেলেও সেটা আর কবে।“ নরানাং মাতুলও ক্রম”, যদি এই সত্য টা আমার নিজের জন্য বর্তায়, তাহলে সেই মাতুলালয় কে জীবনের মাস্তুল হিসেবে স্বীকার করতে পুরোটাই অরাজি,  মার জুটি সেখানে মেলা ভার, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ছিল আছে ও থাকবে। তাই আবার করে প্রচলিত কথায় ফিরে আসি যম, জামাই, ভাগ্না তিন নয়  আপনা, তাই হয়তো ভাগ্না হিসেবে মাতুলালয় কে আজ থেকে আপনার  স্বীকার করতে মনে মনে বেশ ঘেন্না করে। 





Comments

sadamata101.blogspot.com

B-47#বিশ্বকর্মা_পূজো

সন্তোষ ঢাকি

B-71#GANESH_PRASADAM. ( গনেশজির ভোগ নিবেদন মোদক ও পূরণ পুলি)