B-23# REBIRTH -পুনর্জন্ম
সুধী পাঠক গণ আমার এই কাহিনীটি একেবারে সত্য ঘটনার উপর আধারিত, আশা করি পড়ে আপনাকেও ভাবিয়ে তুলবে জীবনের আসল মূল্যবোধ।
পুনর্জন্ম
গতবছর অর্থাৎ সালটা 2019, দিনটা খুব সম্ভবত 20শে জানুয়ারী, বেশ জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে, এক কাপ চা হাতে ব্যালকনি তে দাঁড়িয়েছি, তখন প্রায় সকাল সাতটা বাজে, প্রকৃতির ঠান্ডা আমেজ, আর সূর্যদেব ও ধীরে ধীরে উঁকি দিচ্ছেন তাই সামান্য উষ্ণতা উপলব্ধি করছি।
প্রায় মাসখানেকের বেশি হবে পাড়ায় এক নেড়ি কুকুর চারটে সন্তানের জন্ম দিয়েছে, তারা প্রত্যেকে সমান তালে খেলে বেড়াচ্ছে বেশ ভালো লাগছে, এমনিতেই কুকুর শাবকদের শিশু বেলাটা বেশ আদরের লাগে দেখতে।
আমার বাড়িটা দক্ষিণমুখী তাও আবার গলির রাস্তাটা বাড়ির সদর দরজায় এসে ঠেকে, আবার রাস্তার ডানপাশে লাগোয়া একটা লম্বা খোলা হাই ড্রেন, হঠাৎ করে দেখি একটা কুকুরশাবক খেলতে খেলতে ওই নালায় পরে যায় , এবং তাকে বাঁচানোর জন্য তার ভাইবোনেরা সমানে কাঁদতে থাকে সেটা বেশ ভালো করে ঠাওর করতে পারছিলাম, তাদের কাকুতি মিনতি আর চিৎকারে তার মা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। একে তো শীতকাল তার উপর একটা সারমেয় শাবক রীতিমতো নালার জল খাচ্ছে, কখনও কখনও সে নালার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে আবার প্রানপন বেঁচে থাকার তাগিদে তারস্বরে চিৎকার শুরু করছে
ইতিমধ্যে পাড়ার বেশ কিছু মহিলা, কিছু লোকজন জামায়েত হয়েছেন, সবাই দেখছেন কিন্তু প্রত্যেকে নিমরাজি নালায় হাত দেওয়াতে, তদুপরি আমি নিজেও দেখছি কিন্তু মনে মনে সংকল্প করে ফেলেছি যে করেই হোক আমায় নামতে হবে ও বাঁচাতে হবে।
নালার অপর প্রান্তে এক বাড়ির নিচে বসে রোদ্দুর পোহাচ্ছে এক পরিচারিকা, তার নাম আমরা বুলা পাগলী বলেই ডাকি ,আদতে সে সত্যিই পাগল সারাটাক্ষন সে আপন মনে বকবক করে, তার চোখের সামনে যা ঘটে চলেছে তাতে কোনো মাথাব্যথা নেই, কোনো কর্ণপাত নেই।
উপায়ান্তর না দেখে, এতক্ষনে পাড়ার লোকেরা বুলা পাগলিকে সমানে অনুনয় বিনয় করতে থাকেন সে যদি কুকুরছানা টি কে নালা থেকে উঠিয়ে দেয় , অবশেষে সে রাজি ও হয়, আর নালার ভিতর থেকে বাচ্চাটিকে একেবারে ঘাড় ধরে হিড় হিড় করে টেনে উঠিয়ে এক অসামান্য নজির সৃষ্টি করে।
সমস্ত ঘটনাটার সময়সীমা বোধকরি খুব বেশি হলে দুই থেকে আড়াই মিনিটের মতন, যেহেতু আমি নিজে আগাগোড়াই চাক্ষুষ সময়ের প্রমান, সেদিন বুলাদির উপর এতো মনে মনে শ্রদ্ধা জন্মেছিলো, সংকল্প করেছিলাম অন্তত আমি নিজে যদি কখনও বুলাদির কোনো উপকারে আসতে পারি নিশ্চয় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবো। সে সুযোগ ও এসেছিলো আমার কাছে, আসছি সেই প্রসঙ্গে একেবারে গল্পের শেষে।
এতক্ষনে কুকুরছানাটি বেশ ঠান্ডায় কাঁপছে, গায়ে নর্দমার আঠালো জল কাদা তাকে বেশ চুপসে দিয়েছে, তার ভাই বোনেরা যেন তাকে বলছে কিছুই হয়নি একটু ঝেড়ে নে আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে, বাচ্চাটি একটু রোদে তার গা ঝেড়ে আবার ছন্দে ফিরেছে ,
এতক্ষনে আমি নিজে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, বেশ আরেক কাপ চা খেতে শুরু করেছি, কিন্তু ঘটনাটা যে এখানেই শেষ নয় তা বুঝলাম কিছুক্ষন পরে।
বাচ্চাটি দৌড়তে দৌড়তে চলে যায় একেবারে মেইন রাস্তার কাছে সেখানে বেশ রোদ ঝলমলে, তাই সে তাকে আরো প্রাণবন্ত করে ফেলেছে মুহূর্তে, আর তার ভাইবোনেরা ও ছুটছে সমান তালে, হয়তো বলতে চায় চল ভাই আবার করে আমাদের খেলা শুরু করি।
কিন্ত বিধাতা যে তার জন্য আরো ভালো কিছু পূর্ব পরিকল্পিত করে রেখেছেন সেটা উনিই জানেন।
মেইন রাস্তা ধরে একটি বাচ্চা ছেলে তার মায়ের সাথে স্কুল যাচ্ছে মায়ের হাত ধরে, হঠাৎ সেই বাচ্চাটি মুহূর্তে তার মায়ের হাতটা ছাড়িয়ে সমানে খেলতে থাকে সেই কুকুর ছানাটার সাথে, কখনো গলা ধরে আদর আবার কখনও দুই পা ধরে হাঁটতে শেখাতে শুরু করে , একেবারে এ যেন এক শিশুর সাথে আর এক শিশুর আন্তরিক মেলবন্ধন।মা সমানে টানতে থাকেন ছেলেকে স্কুলে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে, এদিকে ছেলে স্কুলে যেতে রাজি নয় কুকুর ছানাটির সাথে খেলবে বলে, সে প্রায় মাটিতে বসে তারস্বরে কাঁদতে থাকে আর কাঁদতে কাঁদতে শর্ত রাখে, যেতে পারে সে স্কুলে, যদি মা কুকুর ছানাটিকে বাড়িতে স্থান দেন।
যেমন বলা তেমন কাজ মা সন্তানের আবদারের কাছে হার মানেন, আবার কুকুর ছানাটি ও তাদের সাথে সমান ভাবে চলতে থাকে,
ফেলে রেখে যায় তার তিন ভাইবোন কে।তারাও ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে থাকে কিন্তু কোনোরকম কর্ণপাত না করে সে চলে যায় মনিবের ঘরে, অন্তত তাকে আর কোনোদিন নেড়ি কুকুর হয়ে থাকতে হবে না রাস্তায় রাস্তায়। যথাযোগ্য থাকার ও খাওয়ার সু ব্যবস্থা তোলা থাকবে তার কপালে, অতিরিক্ত পাওনা আদরে তার জীবন চলে যাবে ভালো ভাবে। বাকি যারা ভাই বোন ফিরে এলো আর ঠিক আমার ব্যালকনির নিচে এসে তারা চুপ করে বসে আছে, তাদের ভাইয়ের চলে যাওয়ার বিরহে, পরের দিন থেকে তারাও আবার ছন্দে ফিরলো এটাই বুঝি পৃথিবীর নিয়ম আর একেই বোধহয় পুনর্জন্ম বলে কারো কারো ক্ষেত্রে।
ওই একই বছরের ডিসেম্বর মাস বুলাদি শুয়ে আছে ঠিক আমার উল্টোদিকের বাড়ির সামনের রাস্তায় লাগোয়া উঠোনে, প্রথমে ভেবেছিলাম রোদ্দুর পোহাচ্ছে, একে তো পাগল মানুষ কখনো শুয়ে থাকে আবার কখনও বসে থাকে। কিন্তু একটু ভালো করে লক্ষ্য করাতে সেদিন বুঝলাম না এ পাগলের লক্ষণ তো নয়, বুলাদি সমানে বিড় বিড় করে কি যেন আওড়াচ্ছে, আর এক মহিলা এক গ্লাস জল এনে খাওয়াতে চাইছেন কিন্তু সমানে গালের পাশ থেকে সেটা গড়িয়ে পরে যাচ্ছে, বুলাদি আজ আর জল খেতে পারছে না, যে বাড়িরটির নিচে সেদিন শুয়ে ছিল তার ছেলের বিয়ে। বাড়িতে লোকজনের ভিড়, লোকে আসছে যাচ্ছে , আবার পাগল বলে এড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। সেদিন বিন্দু মাত্র দেরি না করে প্রেসার মাপার যন্ত্র টা নিয়ে নেমে পড়ি আর মনে মনে বলি আজ এই তো আমার সুযোগ বুলাদির জন্য যে সংকল্পটা আমি বহু আগেই করেছিলাম তার ষোলো আনা শোধ করার সময় এসেছে।
বুলাদির প্রেসার টা মেপে দেখি একেবারে উপরের দিকে, তার মধ্যে সে রীতিমতো ঘামছে, আসতে আসতে তাকে জিজ্ঞাসা করাতে সে যে কথাটা বলেছিলো আজও ভুলবো না, বলছিলো “মাথায় কেমন যেন কারেন্ট মারছে “, একেবারে বুঝেছিলাম তার হয়তো সেরিব্রাল এট্যাকের এটা পূর্বাভাস, আর আজ বুলাদি কোনো পাগলের মতো কথাও বলছে না। তাই আর দেরি না করে তাকে আমার গাড়িতে উঠিয়ে পাড়ার এক মহিলাকে নিয়ে সোজা চলে যাই কাছাকাছি এক সরকারি হাসপাতালে। দীর্ঘক্ষণ ডাক্তার দেখার পরে বলেন আর হয়তো ঘন্টাখানেক দেরি হলে অনেকটাই শেষ হয়ে যেত, বুলাদির mild attack হয়েছিল, যাক বেশ কিছু খরচাপাতি আমি বহন করতে পেরে নিজেকে বেশ ঋণমুক্ত লাগছিলো, কারণ সেই বছরেই বুলাদি একটা ভালো কাজ করেছিলো কুকুর ছানাটাকে বাঁচিয়ে যা আগেই বলেছি। বুলাদি ছাড়া পায় হাসপাতাল থেকে প্রায় সাতদিন পরে, কিন্তু ছাড়া পাওয়ার সময় আবার সে তার নিজের ছন্দে ফেরে অর্থাৎ পাগলামিতে। সে হাসপাতাল থেকে আসতে চায় না আর সমানে আমার নাম ধরে বলে আমি গাড়ি নিয়ে না গেলে সে আসবেনা।
মানুষ হিসেবে অন্যের জন্য কিছু করতে পেরে নিজেকে আজও ভালো লাগে, বুলাদি তো আমাদের থেকেও অনেক মহৎ কাজ করেছিল একেবারে নিঃস্বার্থে এটাই তো মানুষের আসল পরিচয়।
দেবপ্রিয় সেন 17.04.2020.
যদি আমার এই সত্যি ঘটনাটি বিন্দুমাত্র ভালো লেগে থাকে, আশাকরি নিশ্চয় শেয়ার করবেন আর আপনার অভিমত আমায় লিখে পাঠাবেন, আপনার অভিমত আমাকে আরো ভালো কিছু লিখতে সাহায্য ও উৎসাহিত করবে।
Comments
Post a Comment
always