B-115#বিয়েবাড়ির সেকাল একাল(দ্বিতীয় ভাগ)

বিয়েবাড়ির সেকাল একাল(দ্বিতীয় ভাগ)
প্রচন্ড গ্রীষ্মের দুপুরে যে লাবড়া নামে মেনুটা বিয়েবাড়ির বক্সঅফিসে সুপার ডুপার হিট হয়েছিল সেই মেনুটাকে বাঁচনোর আপ্রাণ প্রয়াসের তোড়জোড় শুরু হতো বিকেল চারটের থেকেই পরিচারিকার কোনোভাবে যদি রাতের একটা পদ বাড়ানো যায় । শুরু হতো আমরণ চেষ্টা গরম জল দিয়ে ফুটিয়ে,ভেন্টিলেশনে রেখে অন্তত পক্ষে সেই দিনটার জন্য প্রাণ ফিরে পাওয়ারএকটা প্রচেষ্টা চলত ।
রাতে খেতে বসলেই হতো মহিলাদের মধ্যে কানে কানে কথা “লাবড়াটা খেয়ো না গন্ধ ছেড়ে গেছে”।বয়স্কা মহিলারা তো  থাকতে না পেরে বলেই দিতেন। রাতের পালা শেষ হতে না হতেই শুরু হতো বিয়ে বাড়ির পরের দিন দধি মঙ্গলের তোড়জোড়। কাকভোরে শুরু বাড়ির বয়স্করা উঠতেন আগে মেয়েকে উঠিয়ে রাতের অন্ধকারে গান্ডে পিন্ডে দই চিঁড়ে খাওয়ানোর পালা একটাই কথা “এখন যে খাচ্ছিস সারাদিনে আর খাওয়া চলবে না একেবারে বিয়ের শেষে দেখবি তখন আর খেতে পারবি না পেট গুলোবে”।
গুরুগম্ভীর নিয়মের জ্ঞানের আড়ালে কন্যা মুখবুজে সে কথা সয়ে নিতো। পরের পর্বের প্রস্তুতি “জল সইতে যাওয়ার” “গায়ে হলুদ” এই সমস্তের বাহার কিন্তু আজও আছে একটু অতিরঞ্জিত মাত্রায়।সেকালে যে জিনিসটা আজও চোখের সামনে ভাসে তা হোলো কন্যার সাথে একজন বসতেন খাতা পেন নিয়ে, বাড়ির বড়দের কড়া নির্দেশ থাকতো “শোন্ যে যা দেবে তার নাম লিখে রাখবি” সে তাই অক্ষরে অক্ষরে সে কথা পালন করতো। যে মুহূর্তে জায়গাটা ভরে যেত সেটা পাশে রাখা একটা আলমারিতে সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়তো।
 এ যেন কানে কানে গোপনে জানিয়ে দেওয়া খেতে এসেছো বাপু উপহার না দিয়ে রেহাই নেই। প্রতিটি উপহারের উপর থাকতো একটা একনোলেজমেন্ট কার্ড যেখানে লেখা থাকতো “ আদরের কন্যাকে তোমার বেহালার পরিচিত মিষ্টি কাকু ও কাকিমা”।কন্যার মিষ্টি কাকু ও কাকিমা অনেক থাকতে পারে, তাই বেহালা নামটা লেখা বিশেষ প্রয়োজন কারণ উপহারটা বিশেষ দামি তখনকার দিনের ক্ষেত্রে একেবারে “বোম্বে ডায়িংয়ের বিছানা চাদরের সেট”। আত্মীয় স্বজনেরা যাঁরা ধরুন সোনার জিনিস দিতেন তাঁরা বিয়ে বাড়িতে এসে এসেই দুপুরের খাবারের পর বার করতেন তাঁদের  অমূল্য সম্পদ  একটি  ক্ষুদ্র কানের দুল, কারণ একটাই-  ন কাকিমা সোনার জিনিস দিয়েছেন এ কথাটা চাউর হওয়ার জন্য ।তাতেই তাঁর পায়াভারি, বাকিরা তাঁদেরকে সমীহ করে চলতেন কেউই খতিয়ে দেখতেন না মূল্যবোধে । অথচ জব্বলপুরের কাকু যে গোদরেজের আলমারি দিয়েছেন তাঁর দাম অনেক বেশি সেদিকে বেচারার নাম নেই। কারণ একটাই মহিলারা তখন ও এখনো সোনার নাম শোনা মাত্র যিনি দিচ্ছেন তাঁকে DC বা balcony তে রাখেন, বাকিরা সব রেয়ার স্টলে।
বর আসতো এম্বাসেডর বা পদ্মিনী প্রিমিয়ার গাড়িতে যা ফিয়েট নামে পরিচিত। বরের গাড়ির সামনে বড় প্রজাপতি একটা  থাকতোই থাকতো আর দুচারটে রজনীর মালা ও গেঁদা ফুল দিয়ে গাড়ি সাজানো হতো। আনতে যেত মেয়ের বাড়ির পক্ষে দুজন একজন বরের সাথে আরেকজন বরযাত্রীর সাথে সেটা এখনো যায় কিন্তু একটু আলাদা।
বরের সাথে যিনি আসতেন তিনি স্থানীয় লোক তাই রাস্তা চিনতেন। আর বরযাত্রীর সাথে যিনি আসতেন বাসে সেই বাসের গায়ে লেখা থাকতো (আমতা বাগনান লম্বাটে গড়নের বাস)
উনি মেয়ের বাড়ির কোনো আত্মীয় অথচ স্থানীয় নন তাতেই হতো মুশকিল রাস্তা না চেনার জন্য হামেশাই বরযাত্রী  দেরিতে আসতেন প্রায় বিয়ে শেষ হওয়ার মুখোমুখি । সেখানেই লাগতো একটা অভিমান আর বচসা। তাই সেটা সামাল দিতে হতো মেয়ে পক্ষের দিক থেকে,হতো সমঝোতা
 "কি করি কতবার বলেছি আপনাদের বরের গাড়ির সাথে রওনা দিতে সকালেও বলা হোলো এক সাথে ছাড়া হবে কিন্ত কে কার কথা শোনে" । কন্যাদায় গ্রস্ত মেয়ের বাবা চুপ করে পরিস্থিতির হজম করতেন - সে ঝগড়া না থামলে বাড়ির লোকজনকে আড়ালে ডেকে বলতেন "ছেড়ে দাও ছেলের পক্ষ বলে কথা" । কিছুক্ষন পরে যেই আতিথিয়তার টিফিন আর থামস আপ আসতো, স্ট্র দিয়ে চুমুক দিতেই ছেলের বাবা বলতেন "বিয়ের ব্যাপার কি আর করার দেরি তো হতেই পারে, মেয়েদেরই তো সময় লাগে বলুন স্নো পাউডার ঘষতে ঘষতে, তার মধ্যে আমাদের পুরোহিত ব্যাটা কত দেরিতে এল, যত দেরি তারই জন্য"। এতক্ষনে দুপক্ষেই বুঝলো দেরি হওয়ার কারণ ।
বিয়েবাড়ির মজাটা জমে উঠতো পরের দিন সকাল থেকে, সব কিছুই বাসি দিয়ে শুরু হতো ।খাওয়ার বাসি, সদর দরজায় সুসজ্জিত ফুল বাসি, রাতে রাত জাগা মেয়ের বাড়ির লোকেদের কাপড় বাসি, কারণ কাপড়ছাড়ার সুযোগ পাননি কোনো ভাবে সিঁড়ির নিচে চৌকিতে ঠাঁই হয়েছিল পিসিমার পাশে পায়ের নিচে দুচোখ বোজার। এত সব বাসি বলেই হয়তো পরের দিনে বিয়ের নিয়মকে  “বাসি বিয়ে” বলা হয়। বাড়ির মহিলারা সে বাসি বিয়েতে অংশ নিতেন কড়ি খেলাতে একেবারে বাসি সাজে।
যে মহিলারা পরশু রাতে কানে কানে বলেছিলো "লাবড়া টা খেয়ো না গন্ধ ছেড়ে গেছে" তাঁরাই আজ সবার অগোচরে খাওয়ার জায়গায় সকাল সকাল গিয়ে বাসি গন্ধ হয়ে যাওয়া ফিস ফ্রাই আর মিহিদানা খাচ্ছেন তাও আবার লুকিয়ে লুকিয়ে।
 বাড়ির পরিচারিকাকে দেখে সবার হিংসে হতো কারণ একমাত্র সে আসতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে, তাও আবার খুব ভোরে। পুরোবাড়িটাই যেন এতটাই বাসি যে সিঁড়িতে কোথাও মিষ্টির চটচটে রস,আবার কোথাও টমেটোর চাটনি, এককোনে পড়ে থাকা লাল নীল ঝিল্লি, উপহার থেকে খসে পড়া একনোলেজমেন্ট কার্ড, সন্দেশের গুঁড়ো, অগণিত উপহারের খালি বাক্স,খালি গামলায় লেগে থাকা হলুদ পোলাও, আর পিঁপড়ে জমে থাকা অজস্র মিষ্টি দইয়ের খোলা হাঁড়ি।
বাসি দিনে একেকজনের একেক ছবি-  পিসেমশাই এসে বসতেন কড়ি খেলা দেখতে কিছুটা নিজের ও স্মৃতিচারণা করে নিতেন নিজের সাথে মিচকি হাসতে হাসতে । সেই আগের দিনের বাসি ধুতি আর পাঞ্জাবী পড়ে পকেটে লাল হেয়ার ব্যান্ড সেটা চোখেই পড়েনি। কখন কোন কচিকাচার দল ঘুমন্ত পিসেমশায়ের পকেটে পুড়ে দিত হেয়ার ব্যান্ড আর নেতিয়ে যাওয়া পান, তারা  ভাবতো এই একটা জায়গায় রাখলে কোনোদিন হারাবে না।কষ্ট লাগতো মেয়ের বাবাকে দেখে উনি সকাল সকাল বাজারে যেতেন টাটকা মাছ কিনতে জামাই বাবাজি কে খাওয়ানোর জন্য। এই একমাত্র দিন উনি বাজারে গিয়ে মাছের কোনো দামদরজ করতেন না বা এখনো করেন না। শুধু টাকাটা দেওয়ার সময় চুপ করে মাছওয়ালাকে বলেন, "জানিস আজ আমার রানী চলে যাবে”। মা লুকিয়ে লুকিয়ে অন্দরমহল থেকে মেয়ের সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় থাক শুধুই এত টুকুই তাঁর কামনা আর নিশ্চুপ মা যেন আরও বধির হয়ে যান মেয়ের যাত্রাকালের আগেই।মেয়ে বিদায় পর্ব  শেষ হলে  বিকালে শুরু হতো উপহার খোলার পালা ।একে একে উপহার খোলা সবাইকে দেখানো কে কি দিয়েছেন। সবথেকে বেশি উপহার আসতো সরবত সেট, জানিনা এত সরবত কে খেতেন, দেখতে বড় আর সস্তা বলেই হয়তো পাওয়া যেত। চায়ের সেট, অজস্র বিছানার চাদর, খুকুমনি আলতা, মাধবীলতা সিঁদুর, তাঁতের শাড়ি, আর ব্যাংক থেকে পাওয়া গিফ্ট চেক তখনকার দিনে SBI থেকে সে গিফ্ট চেক ইস্যু হতো।
এ সমস্ত দেখতে দেখতে সেখান থেকেই শুরু  হতো আত্মীয়দের উপহার দেওয়া, এখনকার  রিটার্ন গিফ্ট এর  মত । ব্যস শুরু হয় সেই মনোমালিন্যের সানাই বাজা,ওকে ভালো টা দিয়েছে আমাকে খারাপটা এই নিয়ে দ্বন্দ্ব আর মন কষাকষি একে অন্যের প্রতি ।এটা থাকতো ততদিন যতদিন সেই আত্মীয় আবার করে স্বগৃহে ফিরে না যান। মান ভাঙতো দুপক্ষেরই যখন যাওয়ার সময়  রিকশোই উঠতেন “বোন কিছু মনে করিস না তোকে ভুল বুঝেছিলাম, এই তো কটাদিন  জীবনে আবার কবে দেখা হবে কে জানে দোষগুনে ক্ষমা করে দিস” । দেখা কিন্তু হতো কারণ সেসময়ে বছরে চারটে বিয়ে তো লেগেই থাকতো কারণ একটাই অনেক ছেলেমেয়ে। আবারও প্রেম, রাগ, অভিমান এই আবর্তে ঘুরতো সেকাল । যেখানে যত প্রেম একে অন্যের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা সেখানে ঝগড়া ও অভিমান ততটাই বেশি এটাই একেবারে  সত্য। একালে শুধুই টপকানো, কে কাকে কতটা টপকালো। টপকাতে না পারলেই ভালোবাসা, টপকালেই ঝগড়া আর সারাজীবনের গাত্রদাহ আর মনোমালিন্য গোপনে পুষে রাখা আর ধরি মাছ না ছুঁই পানির একটা প্রকারান্তে  ফেকাসে হাসি ।
      
আসছি বিয়ের একাল নিয়ে পরবর্তী অধ্যায়ে........





Comments

sadamata101.blogspot.com

B-47#বিশ্বকর্মা_পূজো

সন্তোষ ঢাকি

B-71#GANESH_PRASADAM. ( গনেশজির ভোগ নিবেদন মোদক ও পূরণ পুলি)