B-119#বিয়েবাড়ির সেকাল একাল (তৃতীয় পর্ব )

বিয়েবাড়ির সেকাল একাল (তৃতীয় পর্ব )
এখনকার বিয়েতে প্রতিটা মুহূর্তেই একটা চমক। সে কালে পরিবেশনে যেটা হতো সেটা হোলো একটা সম্পর্ক গড়ার ষোলোআনা সদিচ্ছে। তাবলে এখন কি সেটা হয়না নিশ্চয় হয় তবে একটা মাপকাঠি দিয়ে ঘেরা, একজন আরেকজনকে ততটাই গুরুত্ব দেন ঠিক যে পরিমান দেওয়ার মতো, একটু বেশিও নয় আবার কম ও নয়।ধরুন আমার আগের কাহিনীতে যে রূপক ন কাকিমা ছিলেন তাঁর এখন বর্তমান পরিস্থিতি কেমন একটু এগিয়ে ভাবা যাক। ধরে নেওয়া যাক ন কাকিমা কোনো মল্লিকা নামে একজনের বাড়িতে মেয়ের বিয়েতে নেমন্তন্ন করতে গিয়েছেন।
              বাবা ঠিক বাড়িতে এলাম তো বাইরের বোর্ডে তো নামটা এক, এত ফোন করছি ধরে না কেন? তাহলে কি বাড়িতে নেই, কিন্তু ফোন টা তো ধরবে। হয়তো বাথরুমে গেছে তাই ধরতে পারছে না । এত সকাল সকাল চলে এলাম ঠিক করলাম কি? ভাবলাম মল্লিকার বাড়িটা দিয়ে শুরু করবো হোলো সব গন্ডগোল পেকে গেলো দেখছি। দেখি না হয় আর কিছুক্ষন অপেক্ষা করে প্রয়োজনে না হয় ফিরে যাবো কি আর করার।
             ও মা ন কাকিমা অনেকক্ষন ধরে তুমি ফোন করছো, কলিং বেল মারছো সব শুনেছি,  কিন্তু কিছু মনে কোরো না জিম করছিলাম তো,ওটা সেরে কপাল ভাঁতি, অনুলম বিলম করছিলাম ।তাই আর কি,মনসংযোগ যেন ব্যাহত না হয় তাই শেষ করেই দরজা খুললাম।
 এত সকাল সকাল কে আর আসবে হয় পেপার ওয়ালা না হয় দুধওয়ালা, ভিতর থেকে একবার বললাম ও ঘুরে এসো আধঘণ্টা পরে, ইসস কেন যে ফোন টা দেখলাম না।আচ্ছা এসো এসো বস কতকাল পড়ে এলে কিন্তু কি ব্যাপার নিশ্চয় মেয়ের বিয়ে নেমন্তন্ন করতে বেরিয়েছ তাই তো নাকি?
                ন কাকিমা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন হ্যাঁ ঠিক বলেছো সত্যিই তাই। তোমার বাড়ির থেকেই শুরু করলাম, আজ যে কত জায়গায় যেতে হবে নর্থ কলকাতা শুরু করেছি আজ, বাড়ি ফিরতে ফিরতে বোধহয় রাত এগারোটার কম নয়। ঐ তো গতকাল হুগলি ঘুরেছি তাও শেষ করতে পারিনি। যাক বসবো না আগে নেমন্তন্নের কাজটা শেষ করি এই নাও কার্ডটা প্রথমেই বলি বিয়ে কিন্তু হবে চারুমার্কেট এর পাশে একটা মল সেখানে কি জানি নামটা? মনে নেই কার্ডে লেখা আছে, শোনো সকাল সকাল যাবে একেবারে ওখানেই সমস্তটা আয়োজন পুরোটাই নিজের মত করে বিয়েতে থেকো, আমি তো একা মানুষ সেই শ্যামবাজার আর চারুমার্কেট করবো তাই বললাম আর কি।
[একা মানুষেরও যে এত বাড়াবাড়ি করতে হয় সেটা ভাবলেও অবাক লাগে ইনিও নেমে পড়েছেন একালের বিয়ের সাথে পাল্লা দিতে,তা নিজের বাড়িতে করলে আত্মীয়স্বজন আসতো না বুঝি?]
         আচ্ছা ন কাকিমা ছেলে কি করে? সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার?আমার টার ও তো একই অবস্থা তাই বললাম আর কি। বিয়ের সাতদিনের মধ্যেই মধুচন্দ্রিমা করতে যাবে,তার পরে ফিরে এসে ছেলে মুম্বাইতে থাকবে আর মেয়ে যাদবপুরে phd করবে এই তো চেনা কাহিনী চলবে । আচ্ছা তোমার মনে পড়ে ছোটোপিসির মেয়ের বিয়েতে জামশেদপুরের সেই বিয়ের কাহিনী। ঐ আমার দেখা শেষ বিয়েবাড়ি 2001 ব্যস, কত জনকে যে সে গল্প করেছি এখন আর সেরকম বিয়ে হয় না । এখন বিয়ে হতে না হতেই একে অপরকে বুঝতে না বুঝতেই চললো মধুচন্দ্রিমাতে লন্ডন, আমেরিকা, প্যারিস, ফ্রান্স, এসবই চলছে 2005 থেকে সবই যেন কেমন পাল্টে গেলো। যাক যাক, তোমার কথা শুনি,আমিই সমানে বলে চলেছি।
         ঐ তো জামাই সে দেশেই থাকবে বলে আগাগোড়াই সিদ্ধান্ত নিয়েছে মানে ডেনমার্ক এ, তারপর একদিন মেয়েও চলে যাবে সেখানে ওরা আগামী জীবনটা সে দেশেই কাটাবে যতদূর শুনেছি। আচ্ছা মল্লিকা বিয়ে তো হোলো অনেক বছর তা ছেলেমেয়ে কিছু হোলো তাদের।
         সে আর কি?দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর কেটে গেছে বিয়ে হয়েছে,মেয়ে একটা কলেজে পড়ায়  অনেক টাকা রোজগার করে সে ডেনমার্কেই থাকে আর জামাই এখন কোপেনহেগেনে। অভাব কোনোটারও নেই যেটা আছে সেটা সম্পর্কের একটা কিছু হলে তো বাঁধন থাকবে।ছাড়ো এ কষ্টটা হোলো মনের, বলে বোঝাতে বোঝাতে দিন শেষ হয়ে যাবে।
অবশেষে বিয়ের দিন এলো একেবারে ঝাঁ চকচকে আয়োজন সমস্তটাই।তাই একটু রেখাপাত করছি সমস্ত ব্যাপারে সরেজমিনে কোনটা কেমন -
বরের সাজ ও আগমন- একালের বিয়েতে ছেলে আসে কোনো অ্যাম্বাসেডর গাড়িতে নয়, ল্যাম্বরগিনিতে চেপে। যাক যুগের পরিবর্তন খুব ভালো কিন্ত সে গাড়িতে ছেলে একা, পিছনে সারিবদ্ধ গাড়ির লাইন।কোনো গাড়িতে ছেলের বাবা,আবার পরের একেকটা গাড়িতে এক একজন আত্মীয়। গাড়ির বাইরের কাঁচে সে নাম লেখা আর প্রায় একই রঙের গাড়ি, ড্রোন চলে একেবারে হিন্দি সিনেমার জগতের সাথে তাল মিলিয়ে একটার পর একটা ছবি। বাজী আর আলোর রোশনাই মনকে উৎফুল্ল করে তোলে এরপর আরও কি নতুন চমক দেখবো।
বৃদ্ধেরা অবাক হয়ে দেখেন এতটুকু মিল খুঁজে পান না আজকের জগতের সাথে। চুপ করে বসে শুধুই উপলদ্ধি করা, কারণ আগের থেকেই পাকাপাকি বারণ আছে বেফাঁস কথা যেন না বলেন তাতে সম্মান খোওয়ানোর ভয়। ছেলে মেয়ে দাদু দিদা ঠাকুমা সকলে ব্যস্ত ক্যান্ডিড ফটো তোলাতে,উপদেষ্টা ক্যামেরাম্যান,উনার কথার বাইরে নো ফোটোগ্রাফি। ছাদনাতলা দশ ফিট বাই দশ ফিটের নয় একেবারে চার পাঁচ কাঠা জায়গা নিয়ে সারিসারি সুসজ্জিত চেয়ার পাতা সিসি টিভি, জাইন্ট স্ক্রিন লাগানো চারিদিকে।
আপনার হারিয়ে যাওয়া নাতি নাতনি কে খুঁজে পাবেন ঐ জাইন্ট স্ক্রিনে দেখলেই। বরের বন্ধুরা আসে একসাথে অন্য গাড়িতে,ছেলে মেয়েদের কাপড়ের সুসজ্জিত বাহার, গায়ে প্যারিসের আতরের গন্ধ, মুখে দামি নেশার বোটকা গন্ধ, তাদের জন্য অন্য স্থানে ব্যবস্থা হুক্কা বার, সাধারণ বার, রঙবেরঙের জুস, আর অনবরত ইংরেজিতে কথার ফুলঝুরি। বিয়ে বাড়ির লোকজন সেখানে খুব একটা ঘেঁষেন না,দুটো কারণ এক তো নেশা ও মাদকস্থল আর দ্বিতীয়ত ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলার থেকে বিরত থাকাই ভালো। 
বৌয়ের রূপ ও সাজসজ্জা – বৌ আসে বিয়েবাড়িতে অনেক পরে কারণ তাকে মেকআপ করতে যেতে হয়েছিল মেকাপ দিকপাল কোনো মেকআপ আর্টিস্ট এর  কাছে, তাও আবার মাস ছয়েক আগের থেকে বুকিং একেবারে সল্টলেকে,মেয়ের সাজ দেখলে চেনাই মুশকিল গায়ের রং,নয় নয় করে সাত আটটা প্রলেপ তো পড়েছেই তা বিয়ের পরে ডলা দিলেই বোঝা যাবে, মাথায় চুল নেই তাও বিশাল টাইট চুলের খোঁপার বাহার, চোখ যেন মৃগনয়নী, আইলেশ, আইব্রো, আর ও কত কি ।
দামি শাড়ির বাহার সবশুদ্ধ মিলে  সৌন্দর্যের শেষ কথা। বৌয়ের সাথে সে সব মেয়েরা থাকে  তাঁরাও কোনো অংশে কম যায় না, প্রত্যেকে পার্লারের সাজে সুসজ্জিত যেন চাঁদের হাট বসেছে। স্টিল ক্যামেরা, মুভি ক্যামেরাই ছড়াছড়ি কোথাও কোথাও আবার ট্রলি ও দেখা যায়। এত বিয়ে নয় মনে হয় নকল বিয়ে হচ্ছে, সিনেমার শুটিং চলছে,কোনো কাট নেই একটাই টেক-এতটুকুই তফাৎ মনে হয়,আসল সিনেমাটাই চোখের সামনে ভেসে আসছে। বিয়ের দিন থেকে মেয়ের একবছর পরে অন্তসত্বা   হওয়ার পুরো কাহিনিটাই তুলে ধরা থাকে কোথাও কোথাও এমনকি ভূমিষ্ট সন্তানকেও দেখানো হয়।
বিয়ের একবছর পরের নীল পরী লাল পরীর কাহিনী। সবটাই যেন ঝাঁ চকচকে তা বেশ ভালো কল্পনার বিয়ে, স্মৃতিতে বিয়ে ওটা ক্যাসেটেই থাকে আসল রূপটা একেবারেই অন্যরকমের। আসি বিয়ের দিনের কথায় বৌ সে তার আসনে বসে অল্প সময়ের জন্য,কারণ তাকেও ছুটতে হয় ক্যামেরাম্যানের নির্দেশনায়, পুরোটাই যে মেক ওভার, একটা চমক, একটা বড়োলোক হওয়ার আদবকায়দার ভ্রান্ত হাতছানি সবেতেই ধরা পড়ে। মজার ব্যাপার হয়  বিয়েতে আগত  অতিথির, তিনিও ছোটেন,তারও উদ্দেশ্য একটাই কোনোভাবে বৌয়ের হাতে গিফ্টটা যদি ধরাতে পারেন, তাই যখনই সুযোগ পান হাতে ধরিয়ে দিতে পারলেই হোলো। অনেক সময় এও দেখা যায়  শুধু ক্যামেরা বন্দী করতে বৌকে নাচতে, সেও নাচে অর্কেস্ট্রার সাথে সঙ্গে গানের লিপ মেলায়।
বাবু আজকালের বিয়ে বলে কথা নিজেকে মেলাতে পারলে ভালো না মেলাতে পারলেই হোলো কটূক্তি আর গাঁইয়ার তকমা । ঠাকুরমশায়ের বড়ই দুর্দশা উনিও শুটিং করছেন ক্যামেরাম্যানদের কথায় একই মন্ত্র বারবার বলে চলেছেন। বিয়ের লগ্ন সে আর কি বলার যিনি কন্যা দান করবেন একপাশে বসে খালি পেটে  গ্লাসের পর গ্লাস লেবুর জল খাচ্ছেন আর কোলে ছেলে মেয়ের বিয়ের মুকুট নিয়ে ছাদনাতলায় বসে।

আসছি একালের বিয়ের খাওয়াদাওয়ার আদবকায়দা নিয়ে পরবর্তী অধ্যায়ে......

Comments

sadamata101.blogspot.com

B-47#বিশ্বকর্মা_পূজো

সন্তোষ ঢাকি

B-71#GANESH_PRASADAM. ( গনেশজির ভোগ নিবেদন মোদক ও পূরণ পুলি)