B-113#বিয়েবাড়ির সেকাল একাল (প্রথম পর্ব )

বিয়েবাড়ির সেকাল একাল (প্রথম পর্ব)
আপনাকে দিই,আপনাকে দেই,এ ছিল সেকালের পরিবেশনের রীতিরেওয়াজ । ঠিক আজ থেকে খুবজোর বিশ পঁচিশ বছরের আগের কথা মেয়ের  বিয়ের সাতদিন আগে আর সাতদিন পরের ছবি । ঠাকুমা, দাদু, পিসিমা, পিসেমশাই, জেঠতুতো দিদি, দাদা, বোনেরা, মাসতুতো, জ্যাঠা তুতো সকলে আসতেন নিয়ম করে।

একজন আসতেন সবার আগে উনি না আসলে হেঁসেল চলবে না, তাই উনার কদর ও তোয়াচ হতো সেই বিয়েবাড়িতে সবার আগে । আমাদের বাড়িতেও সেই একই মহিলা আসতেন,ঘুরেফিরে সমস্ত অনুষ্ঠানে যেতেন- তিনি আমাদের জেঠতুতো বড়বৌদি,একজন অসম্ভব দায়িত্ববান মহিলা। একদল খাটতো, একদল সমালোচক থাকতো শুধু আসতো বিয়েবাড়ির ভুল ধরতে, আরেকদল শুধুই  ফরমাস খাটাতো, বুড়োবুড়িরা গোল করে বসতেন এক জায়গায় আর সমানে সকলের প্রণাম নিতেন আর বলতেন “বাবা কত বড় হয়ে গেছে সেই দেখেছিলাম কত ছোটো যখন ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম জব্বলপুরে”। ব্যস শুরু, এখান থেকেই জব্বলপুরের কাহিনী আর বিয়েবাড়ির গল্পের মোড় টান টান উত্তেজনায় রমরমা হয়ে উঠত ।
আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কেউ না কেউ আগেও সেখানে গেছেন তাই উড়ে এসে ধপাস করে বসে পড়তেন সেই জব্বলপুরের গল্প নিয়ে।এ ছিল বিয়ের দুই তিনদিন আগের একটা ছবি। নতুন কোনো আত্মীয় আসলে তো কথাই নেই। কলপাড়ে বিয়ে বাড়ির কোনো মহিলা থাকলে আগেই জোকার, বলা নেই কওয়া নেই  “ওমা কে  এসেছে দেখো , এত দেরিতে কেন বাপু”। যিনি এসেছেন সেই নামটা কখনোই অন্দর মহলে পৌঁছতো না শুধু জোকার আর জোকার। তা দেখে ছোটো ছোটো মেয়েরাও জোকার দিত নির্দ্বিধায়, এভাবেই তারা ও জোকার দেওয়া শিখে যেত। আমার মা জোকার দিতে পারতেন না তাই এত জোরে জোরে উলু উলু বলতেন, তাতে যিনি জোকার দিচ্ছেন উনিও চুপ হয়ে যেতেন।
যাক আত্মীয়  তো এলেন, কিন্ত জব্বলপুরের একদল যাঁরা মেতে উঠেছিলেন,  তাঁরাও উৎকন্ঠার বহিঃপ্রকাশ করতে সভা ভঙ্গ করে বেড়িয়ে আসতে আসতে বলতেন “বলবি তো কে এসেছে” ততক্ষনে বাড়ির উঠানে ভর্তি হয়ে যেত নতুন কে স্বাগত জানাতে । রান্নার লোক আসতো বড় বড় খুন্তি আর ঝাঁজরি নিয়ে (আলু ভাজা আর বোঁদে বানানোর), আর সঙ্গে তিনচার জন মহিলা নিয়ে। তা দেখে বাড়ির ছোটো ছোটো মেয়েরাও চমক দিত জোকার দিয়ে, অন্দরমহলে তারা ভাবতো এরাও বুঝি আবার নতুন আত্মীয়। ঝামেলা বাঁধতো বাথরুমের দুটো হয়তো বাথরুম তিরিশ জন বাড়িতে আত্মীয়। যিনি ঢুকেছেন তিনি সহজে  বেরোতেন না আর কত যে ঠকঠক কড়া নাড়ার আওয়াজ পেতেন। বিয়ে বাড়ির গৃহকর্তা আশেপাশের বেশ কিছু বাড়ি আগের থেকেই ঠিক করে রাখতেন যাতে আগত অতিথিদের কোনো অসুবিধে না হয়। দাদারা যেতেন বাবাদের সাথে বাজারে,একটা ব্যস্ততা থাকতো প্রত্যেকের কাজের। সকাল সকাল তারস্বরে একটা প্রচলতি সানায়ের সুর রাগ ভৈরবী প্রায় সমস্ত বিয়ে বাড়িতেই বাজতো ।
 বেলা বাড়লেই বাজতো “লাজে রাঙা হোলো কনে বৌ গো” আর কচিকাঁচাদের আসতে করে শোনা হিন্দি গান। যদিও তখন তেমন প্রচলন ছিল না পশ্চিমবঙ্গে হিন্দি গানের। তবে হ্যাঁ মাইক ছিল যাঁকে এদেশের ভাষায় বলা হতো চোঙা। যত লম্বা চোঙা তত তার আওয়াজ। কিছুক্ষন চলার পড়ে সে চোঙাও নিজের সুর বার করতো টে টু করে অবশ্যই ইলেক্ট্রিসিয়ান চলে যাওয়ার পরে। সে যেন বলতো বাজতে পারি একটা শর্তে যদি ইলেকট্রিক কাকু আমার সঙ্গে থাকেন।পাড়ার লোকেদের বিরক্তির এক শেষ মনে মনে বলতো কবে যে শেষ হবে বিয়েবাড়ির হিড়িক। এসে অবশ্য কেউই বলতো না কারণ দুবেলা পাত পেড়ে খাওয়ার নেমন্তন্ন পাকা থাকতো। বাড়ির সামনে বসতো দোতলা সমান নহবত। বাবা বলতেন বুঝলি খোকা “এই নহবতের উপর বিসমিল্লাহ খান তাঁর সানায়ের জাদুকরী দেখান”। শিশুমনে ভাবতাম এই বুঝি বিসমিল্লাহ খান আসবেন আর নহবতে উঠে বসবেন কিন্তু উঠবেন কি ভাবে সিঁড়ি কোথায়, একটা কল্পনায় সেটাও ভাবা হয়ে যেত।
নহবতের ঠিক নিচে লাল ছেঁড়া গালিচা পাতা থাকতো সেটা পৌঁছতো সদর দরোজা পর্যন্ত। ডেকোরেটর্স কে কিছু বললেই সে বলতো কিছু করার নেই যা আছে এই আছে ওটা বিকেলে ঠিক এডজাস্ট করে দেবো পাপোস ঢেকে। ততক্ষনে কচিকাঁচারা খেলতো এই গালিচার উপর আবার কেউ কেউ ঐ ছেঁড়া গালিচায় পা আটকে বিপদ ও ঘটাতো।
শিশুদের একটা নেংটু দৌড় হতো মায়ের হাতে তাঁর হাফ প্যান্ট নিয়ে তিনিও দৌড়োচ্ছেন উদ্দেশ্য বাথরুমে যাওয়ার কিন্তু সে উপায় ও নেই বাথরুম সারাটাক্ষন বন্ধ কেউ না কেউ যাচ্ছেনই। একটা বাচ্চাকে দেখে বাড়িতে আগত আর বাচ্চারাও প্রস্তুত হতো সেই বাথরুম প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে, তাতে যেটা হতো সারাটা বিয়েবাড়ি একটা দক্ষযজ্ঞে পরিণত হতো মায়েদের ও বাচ্চাদের। উপায়অন্ত না দেখে বাচ্চারা বলেই ফেলত” চলে গেছে আর হবে না”। মায়ের স্বস্তির নিঃস্বাস আর নেংটু বাচ্চারা শুরু করতো গাড়ি গাড়ি খেলা ঐ নহবত তলার নিচে মুখে আওয়াজ “ভুরুং ভুরুং” তাদের মনের গাড়ি চলতো বড়জোর আধঘন্টা তারপরেই শুরু পেটের “গুরুং গুরুং” । কাউকে না  বলে বাচ্চাদের দল নহবত গেটের ডাইনে বা বাঁয়ে বড় নালার পাশে লাইন করে বসতো কেউ কেউ আবার তাদের কলাকুশল দেখাতো জিলিপির প্যাঁচ বানিয়ে। গৃহস্তের বাড়িতে স্নানের পর্ব শেষ হতে না হতেই টিফিনের পর্ব লুচি তরকারি সঙ্গে বোঁদে। এর চল অবশ্য এখনো আছে শুধুই এটাই পাল্টায়নি। ডেকোরেটার্সের ভ্যান আসতো একের পর এক তাঁর দায়িত্ত্বে থাকতেন বাবা বাদে  বাড়ির অন্য বড় কেউ ।
মালসা, বড় নৌকো ডোঙা মিষ্টি আনার জন্য, এলুমিনিয়ামের ট্যাপ খাওয়া বালতি, সঙ্গে দুটো বা তিনটে পিতলের বালতি ,জলের জগটা কিন্তু আসতো পেতলের বড় মুখওয়ালা বেশির ভাগ সময়ে বাচ্চারা এটা ব্যবহার করতো আর কলাপাতার উপরে সন্তুলান হারিয়ে জল ঢেলে দিত।
 আসতো ছোটো বড় টেরা বাঁকা হাতা ও লোহার খুন্তি, বটি থাকতো কিন্ত
ভোঁতা,এলুমিয়ামের জগ, পঞ্চাশের উপর নোংরা রং চোটে যাওয়া স্টিলের চামচ,
একটা কিংবা দুটো বাঁশের ঝুড়ি ভাতের মাড় ঝরানোর জন্য, শতাদিক মাটির গ্লাস, মাটির খুঁড়ি, মাটির বাটি সেটা অবশ্য প্রয়োজন হতো বিয়ের দিন মাংস দেওয়ার  জন্য তাই সেটা হেঁসেলে আলাদা করে সরিয়ে রাখা হতো।  এত গেলো বাসন কোসনের ফিরিস্তি। এর পরেই যেটা ঢুকতো তা হোলো বালিশ,তোশক,চাদর,শীতকাল হলে লেপ কম্বল, আর মেয়ের বসার জন্য তখনকার দিনে সিংহাসন
চেয়ার আর বরপক্ষের বসার জন্য মখমলের তাকিয়া,মখমলী চাদর, আর থাকতো কাঠের ফোল্ডিং চেয়ার যার বেশিরভাগই মেঝেতে সমান  বসতো না,
একটা টাট্টু ঘোড়ার মত, বসলেই টগবগ করতো সামনে পেছনে দোলাচালে। এই চেয়ারে বসেই আড্ডা জমতো বড়দের সেই সকালে তৈরী করা এক গজ চা (তিন ফুটে এক গজ)।
         দুপুরের খাওয়ার খাদ্য তালিকায় থাকতো মাছের মাথা দিয়ে সোনামুগ ডাল,ঝুড়ি আলুভাজা বাদাম ও  কাড়িয়াপাতা সহযোগে, কোনো কোনোদিন লম্বা লম্বা বেগুন ভাজা, এর পরেই আসতো বড়ি দিয়ে পাঁচমিশালির ঘণ্ট, লাবড়া এটা বাঙালীর চিরপরিচিত খাবার, মুড়িঘন্ট, কাতলামাছের কালিয়া সাথে এক পিস  লম্বা লম্বা আলু, টলটলে  টমেটোর চাটনি, অতি টকবিশিষ্ট গন্ধওয়ালা দই, শরীর সম্বন্ধে যাঁরা সাবধানী তারা আবার কেউ কেউ নুন দিতেন সে দইয়ে।
 এর ব্যাখা তখনও পাইনি আজও পাই না,বলেন এতে  নাকি হজম হতো খুব তাড়াতাড়ি। শেষ পাতে বোঁদে। এটা চলতো তিনবেলায় । হালুইকরকে অনুমতি দেওয়া থাকতো তিনচারদিনের একসাথে বানাতে। আচ্ছা হ্যাঁ যেটা বলা হয়নি খাবারের শেষ পাতে খুবই বাহবা পেত লাবড়া তাই আবার করে ভাত। সমস্ত পরিবেশন টা হতো কলাপাতায় আর ডিসকো নাচে অংশ নিতো সন্তুলান হারানো মাটির গেলাস। যাঁরা খাওয়ার মধ্য ভাগে জল খেতেন আগে খাবার টা ভালোভাবে পাকিস্থলীতে পৌঁছনোর পর, তাঁদের অনেকের কপালে দুঃখ নেমে আসতো কারণ মাটির গেলাসটি ধরতেন ঠিক পাতের উপরেই, আর ফুটো গেলাসের হড়হড়িয়ে জল পড়ে পাতে খাবার গুলো মিলেমিশে একসাথে বন্ধুত্ব জমাতো। 
    


      আসছি পরের সংখ্যায় সেকেলে কে নিয়ে 


Comments

sadamata101.blogspot.com

B-47#বিশ্বকর্মা_পূজো

সন্তোষ ঢাকি

B-71#GANESH_PRASADAM. ( গনেশজির ভোগ নিবেদন মোদক ও পূরণ পুলি)