B-144# আমার বায়ুসেনার দিনগুলি (তৃতীয় ভাগ)

আমার বায়ুসেনার দিনগুলি (তৃতীয় ভাগ)


মনে ভাবিলাম মোরে ভগবান রাখিল না মোহ গর্তে, তাই লিখি দিল বিশ্ব নিখিল দুই বিঘার পরিবর্তে আমার তিন কাঠার উপর বাস, বিধাতা যেন আমায় বিশ্বরূপ  দর্শন করাচ্ছেন, করাবেন আগামী দিন গুলো এয়ারফোর্স  এসে একটার পর একটা জিনিস শিখলাম প্রথমেই এখানে  কেবলি হস্তান্তর হয় আমাদের নিয়ে আমাদের প্রায় আড়াইশো ছেলেদের দেখার ভার এসে পড়লো কর্পোরাল বেবির হাতে এখানে কাউকে ডাকতে হলে প্রথমে তাঁর পদের নাম তারপর তাঁর নিজস্ব নাম বলে ডাকতে হয় কর্পোরাল বেবি এক মধ্যবয়সী যুবক, টাক মাথা, বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা, বেশিরভাগ সময়টা হাফ প্যান্ট পরিহিত, কম কথা বলেন, দক্ষিনী মানুষ আমাদের যে জায়গায় প্রথমেই ঠাঁই হোলো সাময়িক  সেটা এক লম্বা বারান্দা কমপক্ষে 200 ফিট তো হবেই, সেখানেই বসে আছিবেলা বেশ হয়েছে আনুমানিক এগারোটা তো হবেই আমি যে জায়গায় আছি তার সামনে একটা সুসজ্জিত বাগান আনুমানিক বাগানটা চল্লিশ ফিট বাই চল্লিশ ফিট হবে বাগানের পরেই প্রায় চওড়া ষোলো ফিট  রাস্তা রাস্তার পরেই ঘন জঙ্গল শুরু এটা বিলেটের সামনের অংশ পেছনটা প্রায় দীর্য জঙ্গল সাত আট কিলোমিটার তো হবেই,যদিও এটা এয়ারফোর্স পরিধির মধ্যেই


সমস্ত জায়গাটা আনুমানিক পনেরো কিলোমিটার তো হবেই তাই নিয়ে এই তাম্বরম এয়ারফোর্স স্টেশনকর্পোরাল বেবি এসে সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা বক্তৃতা দিলেন রাশভারি গলায় প্রত্যেককে নিজের পরিচিতি দিতে বললেন শুধুই নাম ও কে কোথা থেকে এসেছি ভদ্রলোকের সম্বন্ধে একটা কথা না বললেই নয় অসম্ভব স্মৃতিশক্তি তাঁর, প্রত্যেকের পদবি একবার শুনলেই মাথায় থেকে যায় আমাকে ডাকতেন সেন বলে সেই একবারই শুনেছেনএবারে উনি শেখালেন আমরা আমাদের পরিচিতি কি ভাবে দেবো, কেউ কলকাতা, আসাম, পাঞ্জাব, মেঘালয় থেকে নয় প্রথমেই বললেন আমরা ভারতীয় আমরা দেশের সেবায় আগামী জীবন উৎসর্গ করতে এসেছি কথাটা বেশ মনে ধরলো উনি বললেন আমরা আমাদের পরিচিতি সবসময় আগে পদবি তারপর নামের প্রথম অক্ষর বলবোতার আগে যেটা বসবে সেটা হোলো আমাদের বর্তমান পদ যেমন ধরুন আমরা এয়ারক্র্যাফট নিয়ে টেকনিকাল ট্রেডে এই এয়ারফোর্স ঢুকেছি তাই নামের আগে আমাদের পদ হবে AC/UT যার মানে হোলো AIRCRAFT UNDER TRAINING এবারে আমাদের একে একে আবারও করে নাম বলতে বললেন আমার নতুন পরিচিতির নাম হোলো AC/UT SEN DP এযেন নতুন পৈতে পড়লাম গায়ে এভাবেই চলতে হবে সারাটা জীবন যতদিন এখানে চাকুরীরত হয়ে থাকবো, শুধু সামনের পদ টা পরিবর্তন হবে যতই প্রমোশন হবে, সেটাও হবে পড়াশুনোর মাধ্যমে অবিরাম পরীক্ষার দ্বারাএরপর কর্পোরাল বেবি জিজ্ঞাসা করলেন কার কোন বিষয়ে ন্যা আছে, হাত তুলতে বাঙালীর একটা ক্ষমতা আছে সবার আগে যায় সেই সোহম রায় হাত ওঠালো জানালো সে গান করে, কিশোরের গান তাকে গান গাইতে বলা হোলো সে একই ভাবে মুখে music দেয় গানের সাথে কর্পোরাল বেবি শুনলেন মাঝপথে তাকে আটকে দিল বললেন তুমি music ছাড়া গান কর ওটা শুনতে হয়তো বেশি ভালো লাগবে সোহম জানালো স্যার আমি এভাবেই নিজেকে রপ্ত করেছি তাই music ছাড়া গান করা আমার পক্ষে অসম্ভব কর্পোরাল বেবি ইসৎ মিচকি হাসলেন পরবর্তীকালে আমাদেরও একটা অভ্যেস হয়ে গিয়েছিলো এভাবে গান শোনার আমি হাত ওঠাইনি,কারণ আমি জানি কয়েকটা কবিতা, সেই স্কুল জীবনে প্রশ্ন কবিতা আর বাবার কাছে শেখা আফ্রিকা, কর্ণ কুন্তী সংবাদ, দুই বিঘা জমি, দেবতার গ্রাস এগুলো মুখস্থ ছিল কিন্তু এই সকল কবিতার কদর এরাই বা কি বুঝবে তাই গুটিয়ে রেখেছিলাম নিজেকেযাক পরিচিতির পালা শেষ, এরপরেই আমাদের জিনিস পত্র সেই বারান্দায় রেখে নিয়ে গেলেন এক বিশাল প্রায় দু কিলোমিটার তো হবেই এক মাঠে


কিছু জিজ্ঞাসা করার উপায় নেই কোথায় যাচ্ছি, কিসের জন্য যাচ্ছি সেখানে পৌঁছতেই আমাদের বললেন তোমরা প্রায় একে অন্যের সাথে সামনা সামনি তিন ফিট দুরত্ব বজায় রেখে একেকটা লাইনে পঞ্চাশজন দাঁড়াও, এভাবে পাঁচখানা লাইন করো, একটা লাইন থেকে পাশের লাইনের মধ্যবর্তী দূরত্বের পার্থক্য  কমপক্ষে বারো ফিট যেন হয়, কিছুই বোঝার উপায় নেই দেখি মাঠের পাশে লাইন দিয়ে জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে কমপক্ষে পনেরো ষোলোটা তো হবেইদূর থেকে যেটা মনে হোলো প্রতিটি গাড়িতে এমন সব জিনিস রাখা আছে হয়তো বা আমাদেরই আমন্ত্রণের অপেক্ষায়, এতটাই বুঝলাম আমাদের সম্ভাষণ করবে তা দিয়েবলতে না বলতেই একটা গাড়ি এগিয়ে এলো প্রথম লাইনের পাশে


দেখি,একেরপর এক জনকে স্টিলের থালা দিয়ে চলেছে, যেই লাইনটা শেষ হোলো অমনি জিপ গাড়িটা পরের লাইনে ঢুকে পড়লো তাতেই বুঝলাম দুটো লাইনের মাঝে এতটা ফারাক কেনএরপর স্টিলের মগ, ছয় জোড়া মোজা, গেঞ্জিও ছয়জোড়া, জুতো,কাপড়ের জুতো,দুটো ভালো জুতো, দুই জোড়া আঙ্কেল জুতো, বালিশদুই জোড়া,   দুই জোড়া  সাদা বালিশের উপরে তোয়ালে, একটা লম্বা পাশ বালিশের আকৃতির  মতো মিলিটারি কালারের ব্যাগ, ব্যাগ টা অনেকটা বিয়ের সময় বরকে বসার জন্য মোটা ও বেশ দীর্ঘাকৃতি চেহারার আর মুখটার মধ্যে দড়ি লাগানো যা সহজেই গিট বাঁধা যায় আর্মির ভাষায় একে কিট্স্ ব্যাগ বলা হয় একটা বেঁটেখাটো মোটা পিতলের জলের বোতল সেটাও আবার মিলিটারি কাপড় দিয়ে মোড়াদুটো সুতির  সাদা মশারি, মোজা ছয় জোড়া, দুটো সাদা, বাকি গুলো কালো, সাদা বিছানার চাদর দুই জোড়া, তিনখানা সুতির সাদা তোয়ালে, চামচ তিনজোড়া, কাঁটা চামচ এক জোড়া,  সর্বমোট প্রায় ষোলো সাতেরোটা তো হবেইপ্রথম অভ্যর্থনাটা বেশ ভালো, যেন বিয়ের তত্ব পেলাম, প্রত্যেকের একজনই স্ত্রী তার নাম ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স, আর একটাই শ্বশুরমশাই সকলের,সে হোলো ভারত সরকার এরই মধ্যে দশমিনিট সময় দিলেন কর্তৃপক্ষ অদলবদল করার বিশেষত জুতো, আর গেঞ্জির পাশের সহকর্মীদের সাথেদেখলাম হয়েও গেলো, তাই নিজের সমস্ত তত্ব নিয়ে কিট্স্ ব্যাগে গুছিয়ে আবার চললাম বিলেটের দিকে তখন ঘড়িতে প্রায় 12.30 টা বাজে


আসার সময় মনে মনে ভাবলাম মানুষ অভ্যাসের দাস, বাড়িতে থাকলে হয়তো সারারাত ট্রেন জার্নি করে আসলে এতক্ষনে কতবার বিশ্রাম নেওয়া হয়ে যেত যাক বিলেটে এসে একেক জনের বিছানার এলোটমেন্ট হতেই খাওয়ার সময় হয়ে গেলো মাঝে স্নান খাওয়ার সময় ধার্য করে দিয়ে গেলো দেড় ঘন্টা কর্পোরাল বেবি বাথরুম তো নয় যেন এক হল ঘর ঢুকতেই সারিবদ্ধ ভাবে কল লাগানো, বাথরুম বিশ পচিশটা তো হবেইস্নানের ঘর গুলো আলাদা আলাদা এখানে কর্তৃপক্ষের কাছে একটা অভিযোগ আছে তাঁরা স্নান খাওয়ার সময়টা এতই অল্প রাখেন সেটা হয়তো বা ইচ্ছে করেই ছেলেরা একসাথে স্নানে গেলে আড্ডা তো মারবেই, আর মারলেই দেরি হবে দুপুরের খাবারের, তাতেই এতটুকু দেরি হলে অধিকাংশ ছেলেরাই খাবার পাবে না পরবর্তীকালে স্নান করতে গিয়ে এটা বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করেছি প্রত্যেকেই ব্যস্ত,তারই মধ্যে দাঁড়ি, হাতের নখ, পায়ের নখ,জুতো পালিশ, বিছানা পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা, এমনকি মশারি ভাঁজ কি করে করতে হয় সেটাও শিখলাম একটু ভাঁজে ভুল হলেই হোলো সারাদিন সেই শাস্তির খেসারদ গুনতে হবে


একটা জিনিস শিখেছিলাম প্রতিটা ক্ষেত্রেই তটস্থ কি ভাবে থাকতে হয় তা এখান থেকেই শেখাদুপুরে ডাইনিং হলে খেতে গেলাম সে বিশাল লম্বা একসাথে চারশো লোক তো অনায়াসে খেতে পারবে গিয়ে দাঁড়ালাম লাইনে হাতে স্টিলের চারটে খোপ ওয়ালা থালা,আর বিশাল মগপ্রথমে দেড়হাতা ভাত, সঙ্গে দেড়হাতা কালো ডাল ওটা নাকি খেসারির ডাল বড্ড শক্তি বর্ধক, তরকারি সঙ্গে ঘি, তারপরেই এক হাতা পোলাও তিন পিস চিকেনবেশি চাওয়ার উপায় নেই, যা দেবে তাই, বড়জোর বাঁচলে সবার হয়ে যাওয়ার পর আবার করে দেবেন একটা কথা বেশ মনে পড়ে গেলো যারা দেখতে রোগা তারা পেটে দারোগাকথাটা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেলো দেখলাম বেশ কয়েকজন রোগাটে গড়নের ছেলে তারা বলছে কিছুই হোলো কোথায় চলে গেলো


কিন্ত একটা জিনিস পরিষ্কার প্রত্যেকের থালা এতটাই পরিষ্কার, থালা দেখে মনে হচ্ছে সবে খেতে এলো এমন চকচক করছে মাঝে সময় পেলাম আধা ঘন্টার বিশ্রাম বিছানা দেখে গা এলিয়ে দিলাম, কারোর সাথে কথা বলতেও ইচ্ছে করছে নাবায়ুসেনার কর্তৃপক্ষ এমনই ভাবে আমাদের সকলের উপরে হাবি হয়েছেন কিছু ভাবারও সময় নাই তাঁরা আমাদের মনে ঢুকে পড়েছেন পুরোদস্তুর ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে গেলো বাড়িতে চিঠি লেখার ইচ্ছেই যেন করছে না চোখ এলিয়ে পড়ে কিন্তু আঙ্গুল গুলো যে ঘুমে এলিয়ে পড়ে তা বুঝলাম এতদিন পড়েমুহূর্তে সময় ঘনিয়ে এলো ফল ইনের (রোল কল)আর্মিতে এটা একটা খুবই পরিচিত কথা নিমরাজি হয়ে প্রচন্ড গরমে দাঁড়ালাম লাইনে সেটা হওয়ার পরেই আমাদের বললো সেই মাঠে যেতে ওখানে দর্জি আসবে উর্দির মাপ নিতে সেখানে সেটা হওয়ার পর ফিজিক্যাল ফিটনেসের জন্য ব্যায়াম হবে বিকেলে পাঁচটা থেকেতারপর মিনিট পনেরোর চা খাবার বিরতিশুনেছি বিকেলে আবার এই মাঠে আনবে আজ শনিবার তাই সিনেমা দেখাতে মনে ভাবলাম আমাদের জীবনটাও একটা সিনেমা হয়ে চলেছে যা নেপথ্যে আমায় ভাবিয়ে তুলছে

https://sadamata101.blogspot.com/2021/02/b-146.html

                            ক্রমশঃ.......

 

Comments

sadamata101.blogspot.com

B-47#বিশ্বকর্মা_পূজো

সন্তোষ ঢাকি

B-71#GANESH_PRASADAM. ( গনেশজির ভোগ নিবেদন মোদক ও পূরণ পুলি)