B-137# ঠাকুরদিদি ও আমার প্রথম বেনারস যাত্রা

ঠাকুরদিদি আমার প্রথম বেনারস যাত্রা


ঠাকুরদিদি নাম টা আসলেই যে নামটা প্রথম আমার মনে পড়ে  সে হোলো আমারই ঠাকুরদাদা, ঠাকুরদিদির স্বামী স্বর্গীয় যামিনীরঞ্জন সেন যাঁর খ্যাতি জীবনের চরম শীর্ষে পৌঁছনো আর সেখান থেকেই আমাদের এই সেন বংশের অনেকটাই পরিচিতিএই যামিনী সেন ছিলেন তখনকার দিনে এম ইকোনকিক্স এ, পাশ করেছিলেন হিজলি জেল থেকে বর্তমানে যেটা মেদিনীপুরে। একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী যিনি জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন লবন আন্দোলনে গান্ধীজির সাথে, তাঁর বহু ঘটনা বাবার মুখে শোনা শুধুই তাঁর সম্বন্ধে এতটুকুই মনে পড়ে  যেদিন চলে গেলেন আকাশবানীর বেতারে  করুন বেহালার সুরটা সারাদিন বেজেছিল আর ভাষ্যপাঠ তাঁরই জীবন কাহিনী রেডিওতেসিপিএমের একনিষ্ঠ স্বাধীনতা সংগ্রামী সে আর কেউ নয় আমারই ঠাকুরদাদা, বাবার নিজের কাকা কেওড়াতলা মহাস্মশানে যে মানুষটা সেদিন ছায়ার মতন ছিলেন তাঁরই মরদেহের  পাশে তিনি পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুবর্তমান যামিনী সেনের ভিটে হাবড়ার মছলন্দপুর থেকে একটু ভিতরে নির্মাণ, যেখানে আজও তাঁর স্মৃতিসৌধ আছে। নির্মাণ স্কুলে সকলের কাছে ইনিও মাস্টারদা নামে পরিচিততাঁর একমাত্র ছেলে আমি বাবলুকাকা বলে ডাকি, বিশেষ কিছু একটা করেননি জীবনে


            সালটা যতদূর মনেপড়ে, 1993- এই যামিনী সেনের স্ত্রী আমার ঠাকুরদিদির সাথে সঙ্গে মা বাবাকে নিয়ে চলেছি বেনারস,তাঁরা যাচ্ছেন ঘুরতে আর আমি যাচ্ছি পরীক্ষা দিতে রেলওয়ের শিয়ালদহ স্টেশন,ট্রেন ঠিক রাত 9.40 মিনিট ছাড়বে পাঁচনম্বর প্লাটফর্ম থেকে যাক ট্রেন ছাড়ার বেশ কিছু আগেই এসে পৌঁছেছি ওমা ঠাকুরদিদি আমায় বলে বসলেনমনা একটু জল ভরে নিয়ে এসো, এই নাও এই জারিকেন টা দিলাম আমার তখন উঠতি বয়স লজ্জা চরম কি করে আনি, দেখি উনি একটা পাঁচ লিটরের প্লাস্টিকের জারিকেন, সেই সময় কেরোসিন আনা হতো আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন আমি নিমরাজি,শুধুই বললাম সে তো অনেক দূর আনতে আনতে ট্রেন ছেড়ে দেবে গো ঠাকুরদিদি উনি আমায় কাছে ডেকে বললেন দেখ ওটা ছেলেদের বাথরুম তা না হলে আমি নিজেই যেতুম, যা না মনা একটু নিয়ে আয় না, কিছু হবে না তোর দাদা বেঁচে থাকতে ওমন জল কত এনেছি আসলে মনা চিন্তাটা মনের বাকিটা সবই এক, জল তো তেষ্টাই  মিটাবে বাবার ইচ্ছে ছিল বর্ধমান থেকে নেবেন উনিও মানা করতে পারলেন না আর আমি লজ্জায় সে জল এনে দিলাম কি আর করারট্রেন ছাড়লো নৈহাটী আসতে না আসতেই মা লুচি তরকারি মিষ্টি বার করলেন সবার জন্যে, দেখি ঠাকুরদিদি মাকে বলে বসলেন, ছোটবৌ আমার জন্য বার কোরো না আমার সঙ্গে চিড়ে আছে আর এক টিন আমূলস্প্রের গুঁড়ো দুধ আছে আমার জল দিয়ে মেখে হয়ে যাবে অমনি খাবার শুরু করার আগে আমায়  বললেন, মনা এক গড়াস খাবি নাকি? আমি গম্ভীর গলায়  বললাম, না আর মনে মনে ভাবলাম,বাবা যে কি করে না,সঙ্গে এই বুড়ি ঠাকুরদিদিকে জুটিয়েছে তীর্থে যেতে আমি খেয়েদেয়ে আপার বাংকে  গিয়ে শুয়ে পড়লাম, আর বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম বাবা কাল ট্রেন কখন পৌঁছবে আর আমরা কোন হোটেলে গিয়ে উঠবো


অমনি ঠাকুরদিদি বললেন মনা ট্রেন ঠিক মত চললে আমরা বিকেল পাঁচটায় পৌঁছবো আর হোটেলের কি আছে আমি তো ভারত সেবাশ্রমের মেম্বার ওখানেই গিয়ে উঠবো, আমি দেশপ্রিয় পার্কের থেকে তাও চিঠি লিখিয়ে নিয়ে এসেছি, দেখবি মনা কি সুন্দর আয়োজন থাকাখাওয়া সব, তবে নিরামিষ আমি  কিছু না বলে শুধু বলেই ফেললাম, এ কি আশ্রমে থাকবো  বাবা?বুঝলাম বাবার কোনো কথা এখানে চলবে না, বলা বৃথা তাই বললাম আমি কিন্তু পরশু পরীক্ষা দিয়েই রাতে ট্রেন ধরবো কলকাতায় ফিরে যাবো তোমাদের যেখানে যাওয়ার যেও পরের দিন বিকেল ছটায় পৌঁছলাম ট্রেন থেকে মাটিতে পা রাখতেই ঠাকুরদিদি বলে উঠলেন আহাঃ এই সেই কাশী অনেক পুন্য  করলে মানুষ কাশীতে আসতে পারে বুঝলি মনা মনার তো গা হিরহির করছে রাগে, জানি না কোথায় যাচ্ছি, কোথায় থাকবো আজ রাত টুকু কোনোভাবে কাটাতে পারলেই হোলোঅবশেষে উপস্থিত হলাম ভারতসেবাশ্রমে দেখি মারমার  কাট কাট  ভিড়, কি না আগামীকাল পরীক্ষা আছে তাই সব ছেলেরা এসেছে দূরদুর থেকে পরীক্ষা দিতে রাতে এখানে থাকবে ঠাকুরদিদি দেখি আরেক মনা পেয়ে গেছেন,এক সাধুকে গিয়ে বলেই ফেললেন এই যে আমার চিঠি আমায় কোন ঘরে থাকতে দেবেন,আমরা  চারজনআমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখছি আর মনে মনে বলছি ঠাকুরদিদি তুমি যতই মনা বানাও এখানে চিড়ে কিন্তু ভিজবে না, কোনো জায়গা পাওয়াইকিছুক্ষন পরে ঠাকুরদিদি এলেন,এসে বললেন চল  মনা সব ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়ে গেছে বলেছিলাম না কোনো অসুবিধে নাআমি খুশি হলাম যাক ঠাকুরদিদির সত্যিই ক্ষমতা আছে একে ঠান্ডা পড়েছে তাও আবার ডিসেম্বর মাস বেনারসের মতো জায়গা কিছুটা আশ্বস্ত হলামদেখলাম একটা লম্বা ঘরের বাইরে ঠাকুরদিদি ব্যাগ থেকে চাদর বার করছেনআমি তো বলেই ফেললাম আরে আগে ঘরে তো ঢোকো তারপর না হয় ওসব বার কোরো ক্ষণকিছু বোঝার বা মুখ খোলার আর জায়গা রইলো না দেখলাম ঠাকুরদিদি চাদর পেতে আমায় বললেন শোন্ মনা আজ রাতের মত এই জায়গায় শুয়ে পড়, কাল বলেছে ঘর দেবে জানিস তোর ঠাকুরদা তো হিজলীর জেলে এভাবেই মাসের পর মাস কাটিয়ে গেছেন


বাবা মায়ের  নিজেও কিছু বলার জো নেই আমি শুধু বাবাকে বললাম এমন জানলে আমি আসতাম নাপরের দিন ঘর পাওয়া গেলো কিন্তু আমি কলকাতায় ফিরলাম একাশুধু বেনারস স্টেশনে বাবাকে বলেছিলাম এই ঠাকুরদিদিকে নিয়ে বেশি ঘুরো না বিপদে পড়বে রাস্তা ঘাটেপারলে দু একদিন আরো থেকে ফিরে যেওবাবা মা ফিরেছিলেন দুএকদিন কাটিয়ে নয় একেবারে তেরোদিনের মাথায় কারণ একটাইবাবা টাকা দিয়েছিলেন ঠাকুরদিদিকে কলকাতা আসার টিকিট কাটতে শিয়ালদাহ জম্মতাওয়াই ট্রেনে কারণ এত লম্বা লাইন  ছিল তাই মহিলাদের আলাদা লাইনটা ফাঁকা আর উনাকে খুবই বিশ্বাস করতেন উনি দেশে একা  বহু ঘুরেছেন বলে যেটা মা একদমই পারতেন না

ঠাকুরদিদি হিন্দি  বিশেষ বোঝেনই না কাউন্টারে গিয়ে বলেন তিন টা জম্মু তাওয়াই এর টিকিট দিতে, তখনকার দিনে রিসারভেশন  হতো খাতায় লিখে, যিনি টিকিট দিচ্ছেন উনি শিয়ালদার টিকিট না দিয়ে জম্মুর টিকিট দিয়ে ফেলেছেনঠাকুরদিদির মন খুবই খারাপ বাবাকে এসে বলেন ঠাকুরপো একটা ভুল হয়ে গেছে, আচ্ছা কিছু হবে না এই নাও পাঁচহাজার টাকা জানি তুমি তৈরী হয়ে আসোনি কাশ্মীর যাবে বলেবিশ্বনাথ না চাইলে কি আর কাশ্মীরের টিকিট কাটি,সবই উনার ইচ্ছে

     আজ একটা কথা মনে পড়ে, মানুষগুলো কতই সাধারণ ছিল জীবন একদিক থেকে আরেকদিক টেনে নিয়ে যায় তাতেও কোনো কিছুই এসে যেত না তাঁদের বাস্তব নিয়ে তাঁরা এতটাই উপভোগ করতেনআজ আমরা বাস্তব কেও আগলে ধরতে পারিনে আর সর্বক্ষণ অবাস্তব নিয়ে ভাবনাচিন্তাসুখী উনারা আমরা নইআহাঃ আজ আফসোস হয় যদি আবার করে ঠাকুরদিদিকে পেতাম প্রয়োজনে বেনারসের সেই মাটিতে শুতে, আর সেই জারিকেনের জল নিশ্চয় খেতাম পরখ করে দেখতাম পারি কিনাসত্যিই পরিস্থিতির সাথে মানানোটা মনের আর বাস্তবকে ছুঁয়ে উপলব্ধি করা সেটা আপস টা আজ বুঝি

Comments

sadamata101.blogspot.com

B-47#বিশ্বকর্মা_পূজো

সন্তোষ ঢাকি

B-71#GANESH_PRASADAM. ( গনেশজির ভোগ নিবেদন মোদক ও পূরণ পুলি)