B-142#আমার বায়ুসেনার দিনগুলি (প্রথম ভাগ)

আমার বায়ুসেনার দিনগুলি (প্রথম ভাগ)

 

1988 সাল 2রা মে, সোমবার মেজদিদির বিয়ে, বাড়িতে আলোর রোশনাই, আত্মীয়স্বজনে ঠাসাঠাসি , ভোর চারটেতে উঠে মেজদিদিকে দই চিড়ে খাওয়ানো আর মহিলাদের জল সাইতে যাওয়া এই ছিল সেদিনের সকালের বাড়ির ছবি আমি আর মেজদিদি দুজনেই নতুন জীবন তৈরী করার প্রস্তুতি নিচ্ছি মেজদিদির  নতুন সংসার, আর আমার নতুন জীবন তাও আবার দেশের প্রতি ব্রতী হওয়ার সংকল্প এযেন দিনটাকে সাক্ষী রেখে আগামী জীবনের একটা প্রস্তুতি মনে মনে ভাবলাম এমন দিন খুব কম লোকের জীবনেই আসে, বড়ই ভাগ্যবান আমিসন্ধ্যে বেলায় বর ঢুকবে সেই সুদূর চক্রধরপুর থেকে আর আমার যাত্রার মাহেন্দ্রযোগ শুরু হবে ঠিক একই সময়ে -গন্তব্য মাদ্রাজ,রাতে ট্রেন হাওড়া মাদ্রাজ মেল


বাড়িতে মেয়ে বিদায়ের কান্নার সুর ঠিক বিয়ের পরদিন দিন হয়, কিন্ত একি!এতো  ছেলে বিদায়ের করুন সানাই বেজে উঠলো বিকেল থেকেই, আমি নিশ্চুপ, মন আমারও খারাপ এদিকে সম্মতি জানিয়েছি কর্তৃপক্ষের কাছে মানে বায়ুসেনার কাছে তাই আমার ওয়ারেন্ট পেপারে পূর্বেই স্বাক্ষর দিয়ে এসেছি, কিছু করার নেই ভোরবেলায় আমাদের নাম একে একে ডাকা হবে ভুবনেশ্বর পৌঁছলে, তখন কম্পার্টমেন্ট চেঞ্জ করতে হবে শুনেছি এই মাদ্রাজ মেলেই একটা আলাদা কম্পার্টমেন্ট আছে যা আর্মি কম্পারমেন্ট বলে পরিচিত আমাকে সেখানেই চলে যেতে হবে ট্রেনটা ভুবনেশ্বর পৌঁছলেই


             সব কিছুই হোলো ভুবনেশ্বরে আমি জানালার পাশে বসে আছি, সঙ্গে নতুন বন্ধু নানান রাজ্যের,কিছুটা আলাপ করছি, আবার কিছুটা মন টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির প্রতি,সঙ্গে সঙ্গী হিসেবে বলতে পারি দিস্তা খানেক ইনল্যান্ড লেটার দিদিকে চিঠি লিখবো বলে ট্রেনটা মাদ্রাজের উদ্দেশ্যে সজোরে ছুটে চলেছে আমি বাঁ দিকে বসে জানালার পাশে চিকচিক করে সূর্যের আলো চিলকার জলের সাথে প্রতিফলিত হয়ে আমার চোখ ধাঁধিয়ে চলেছে শেষ আর হয়না এই প্রথম আমার দেখা চিল্কা কি বিশাল শেষ আর হয়না চিল্কার মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো টিলা,দেখি বেশ বড় বড় নৌকো সে উদ্দেশ্যে চলেছে, টিলার উপর মন্দির বুঝলাম এটা একটা দর্শনীয় জায়গা তাই লোকে হয়তো চলেছে, দু চোখ ভরে উপভোগ করছি আর মনে মনে দ্বিধা ঠিক করছি কিনা, যাচ্ছি তো


একটা সময় নিজেকে মনে হোলো যেন একজন কয়েদি সবার থেকে, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন এক অনির্দিষ্ট যাত্রাপথে পাড়ি দিচ্ছি জীবন আমার নয় মনটা তাই ডুকরে ডুকরে কাঁদছে, ট্রেন এসে দাঁড়ালো বেরহমপুর স্টেশনে  মন বললো আবার কোন বেরহমপুর, ছোটবেলায় পড়েছি বেরহমপুর সম্বন্ধে সে তো পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় ট্রেন দাঁড়াতেই দরজার সামনে লেখা, দেখ্লাম বোধগম্য হোলো না সে ভাষা, ইংরাজিতে লেখা বেরহমপুর


বুঝলাম আমি দক্ষিণ ভারতে ঢুকে গেছি ওটা বোধহয় তামিল ভাষায় লেখা হাতে পেন ইনল্যান্ড লেটার নিয়ে বসে পড়লাম,ছোড়দিকে লেখা আমার প্রথম পত্র কাল রাত হাওড়া থেকে এই বেরহমপুর পর্যন্ত আমার অভিজ্ঞতার কথা একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেখি তিনখানা ইনল্যান্ড লেটার লেখা হয়ে গেছে আমার কাহিনী লিখতে লিখতে পরক্ষনেই গাড়ি এসে থামলো পলাশী তে, ঠিক পড়লাম তো? সেও তো মুর্শিদাবাদে পলাশির যুদ্ধ, ভালো করে নামটা পড়লাম দেখলাম আমি ভুল স্টেশনের নাম পলাশা, কিন্তু একি তাহলে কি দক্ষিণ ভারতীয় লোকেদের বাংলা নাম গুলো বিশেষ পছন্দ ছিল, তাই তাঁরা একটু বিকৃত করে নাম গুলো দিয়েছে।


দিদিকে লেখা চিঠিতে এই পলাশার নাম ও উল্লেখ করলাম, প্রায় অনেকগুলো চিঠি লেখা হয়ে গেছে তাই ভাবলাম আজ এই পর্যন্তই। ঘড়িতে সময় প্রায় 12.20 ট্রেন ঢুকছে একটু দুলকি চালে আস্তে আস্তে, বাইরে দেখ্লাম অনেক গুলো লাইন, বেশ কয়েকটা রেলওয়ে ক্রসিং পার হয়ে চলেছে, মাঝে মধ্যেই গায়ে  ইন্ডিয়ান অয়েল লেখা রুপোলি ট্যাংক সারিবদ্ধ রেল লাইনের পাশে বুঝলাম এক কোনো বড় স্টেশন নিশ্চয় সময় লাগছে যখন দেখি একটা কেবিনে লেখা বিশাখাপত্তনম  মনে মনে কত ছোটবেলাকার ছবি ভেসে আসছে শীতকালে পরীক্ষার আগে রোদে বসে পা ছড়িয়ে কত চীৎকার করে করে পড়েছি বিশাখাপত্তনম মানে জাহাজ তৈরির কারখানা এযেন অতীতের সাথে একটা মনের মেলবন্ধন ঘটাচ্ছে আহাঃ যা পড়েছি তাই দেখছি চোখের সামনে কি সুন্দর মেলবন্ধনের সেতু বাল্যকাল আর যৌবনের মাঝে যোগ সাধন করছে এক অতিকায় জাহাজ শুধুই ভাবাচ্ছে আর ভাবাচ্ছে স্মৃতি গুলোকেবিশাখাপত্তনমে গাড়ি থামতেই তড়িঘড়ি নেমে পড়লাম, আমার বরাবরের একটা অভ্যেস আছে নতুন জায়গা আসলে সেখানে পা রাখা, সেই জায়গার সাথে নিজেকে একাত্ম করা সেটা ছোটবেলার থেকেই বাবাও নামতেন তাঁর সাথে আমি নিজেও তাই সে অভ্যেস ছাড়তে পারিনি


নেমেই ছুটে গিয়ে প্রথমেই যেটা করলাম সেটা সেনাবাহিনীর পোস্টঅফিস খোঁজা  আমাদের সাথে একজন অফিসার ছিলেন উনি ট্রেনেই বলেছিলেন সেনাবাহিনীদের জন্য ভারতবর্ষের প্রায় বেশিরভাগ স্টেশনে একটা আর্মি পোস্ট অফিস আছে, তাই মনে মনে আনন্দ হয়েছিল যাক দিদিকে লেখা চিঠিগুলো এখানে ড্রপ করলে কাল বা পরশুর মধ্যে বাড়িতে পৌঁছে যাবে, সেটাই করলামএরপর ছুটে গেলাম একটা দোকানে কিছু খাবার কিনতে, দক্ষিনের বেশিরভাগ দোকানে হয় ধোসা, ইডলি বা সাম্বার বড়া পাওয়া যায়, আমার কাছে মন্দের ভালো লেগেছিলো সেই নেতিয়ে যাওয়া ঠান্ডা ধোসা বাকি গুলো কোনোকালেই পছন্দ করতাম না ইডলি তো কোনো টেস্টই পেতাম না, ওটা দেখলেই ভাপা পিঠের কথা মনে পড়ে, আমাদের বাড়িতে পিঠেকে বাংলাদেশী চট্টগ্রামের ভাষায় ধুই পিডাবলে ভারী চমৎকার শীতকালীন খাবার ঝোলা গুড় বা খেজুর  গুড় দিয়ে খেতে হয়


সাম্বার বড়া একেবারেই বিরক্তি লাগে দেখে যাক কোনোক্রমে দুটো ধোসা খেয়ে মাঝামাঝি পেটের জ্বালাটা কমলোএতক্ষনে দেখি ট্রেনটা হাল্কা ঝটকা দিল আস্তে আস্তে উল্টোদিকে এগুতে থাকলো মনে ভাবলাম ট্রেন যেদিকে যাওয়ার কথা সেদিকে যাওয়াই তো স্বাভাবিক কিন্ত উল্টো দিকে কেন, ততক্ষনে ট্রেন একটু বেগে এসেছে আমি কিছু না বুঝেই ছুটলাম ট্রেনের কামরার দিকে দৌড়োতে দৌড়োতে ট্রেনে উঠে পড়লাম মন তখনও মানলো না এটা আবার কেমন বাইরে তাকাতেই চিত্রটা পরিষ্কার হোলো

          তখন সময় প্রায় 1.10 হবে মনটা কেমন যেন ভার হয়ে গেলো বাইরে তাকাতেই, এযেন বাড়ীর থেকে আরো দূরে চলেছি ক্রমশ সম্পর্ক গুলো যেন আমায় অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেবে এক অত্যন্ত নিয়মশৃঙ্খলার বেষ্টির মধ্যে, এজীবন আমি তো চাইনি, কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কি করতে যাচ্ছি বুঝতে না বুঝতেই আমাদের রোল কল শুরু হোলোমন গুমরে গুমরে উঠলো আর সমানেই বললো কি যেন কয়েদির জীবন যেচে বরণ করলাম মা বাবা দিদিদের অমতেই তো চলেছি তাঁরা তো মোটেই রাজি ছিলেন না কিছুটা বিষন্ন ভারাক্রান্ত দেখে আমারই এক দক্ষিনী সহকর্মী নাম জিজ্ঞাস করাতে সে বললো তার নাম রিচার্ড নিক্সন আমাকে তুমি নিক্সন বলে ডেকো, সেই ভোর বেলা চিল্কা থেকে দেখছি তুমি সমানেই চিঠি লিখে যাচ্ছ, বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে বুঝি? আমি বললাম হ্যাঁ, সে বললো আমার বাড়ির উপর দিয়ে ট্রেনটা যাবে জানো আর কিছুক্ষন পরে সেখানে পৌঁছবে,ট্রেনটা দাঁড়াবে সেখানে, স্টেশনে আমার সবাই আসবে মা বাবা দিদি জায়গাটার নাম বিজয়নগরম তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো তাঁদের আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম তুমি তো তাহলে এখান থেকেই উঠতে পারতে ভারী মিষ্টি দেখতে ছেলেটি এমনিতেই কৃষ্ণকায় কিন্তু হাসির আদলটা আজও চোখের সামনে ভাসে সে হেসে বললো কি করে হবে শুনি তোমার আমার ট্রেনের সবারই তো একই সিলেকশন সেন্টার  ভুবনেশ্বর, তাই তো ওখান থেকে উঠেছি তুমি কি কলকাতা থেকে উঠেছো? বুঝেছি তার মানে তুমি স্পেশাল পারমিশন নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলে তাই সেখান থেকে উঠতে পেরেছো, তা না হলে কোনোভাবেই মাঝপথ থেকে ওঠা সম্ভব নয়  বলতে বলতে ট্রেন এসে পৌঁছলো বিজয়নগরম স্টেশনে দেখি তার বাবা, মা, দিদি, কাকু প্রায় জনা দশেক এসেছেন ছেলের সাথে দেখা করতে নিক্সন আমাকে তার মা বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, তারপর সামান্য আলাপচারিতার পরে ট্রেন ছাড়লো জানালা দিয়ে দেখি তার মায়ের চোখের কোণ চিকচিক করছে আর নিক্সন গেটে দাঁড়িয়ে মাকে চুম্বন বিনিময় করছে দেখে আমি সেদিন আমাকেও আটকাতে পারিনি নিজের মায়ের কথা, মেজদিদির বিয়ের বিদায়ের প্রস্তুতির কথা একে একে মনে পড়ে গেলো, কিছুক্ষন পরে দেখি নিক্সন এলো আমার পাশে এসে বসলো আর কাঁধে হাত দিয়ে বললো কিছু মনে কোরো না এখন নয়, কিছুক্ষন পরে আমায় একটা ইনল্যান্ড লেটার দেবে...........


https://sadamata101.blogspot.com/2021/01/b-143.html

                                    ক্রমশঃ

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Comments

sadamata101.blogspot.com

B-47#বিশ্বকর্মা_পূজো

সন্তোষ ঢাকি

B-71#GANESH_PRASADAM. ( গনেশজির ভোগ নিবেদন মোদক ও পূরণ পুলি)