B-12 # KITE (ঘুড়ি) (শুভ সুমেধার প্রথম ভাগ)
ঘুড়ি
সুমি, সুমি কোথায় গেলে, আরে আমার চশমাটা দাও তো আর গীতবিতান টা একটু নিয়ে এসো , বেশ ইচ্ছে করছে আমার পছন্দের রবীন্দ্রনাথের একটা গান গাই - ” রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও, যাও গো এবার যাওয়ার আগে “.....
বাবা আজ সকাল থেকেই প্রেম উথলে উথলে উঠছে দেখছি শুভ, হোলোই বা বিবাহবার্ষিকী তাতে কি হয়েছে। এতটা বছর কেটে গেছে বিয়ে হয়েছে কোনোদিনও তো এত সখ জাগেনি তোমার । ভোর বেলা থেকেই শুরু হোলো বিসমিল্লাহ খাঁ কে নিয়ে সানাই - রাগ ভৈরবী , সেটা শেষ হতে না হতেই বনলতা সেন, আবার রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্যায়ের গান , এখন আবার নিজে গান গাইতে বসলে ! কি হচ্ছে শুভ, আজ মালতি আসবে না বলে দিয়েছে তাই আর ডেকো না। ঘরমোছা , বাসনমাজা সব করতে হবে। আর হ্যাঁ শুভ, একটু বাজারে যাও, আলু আনতে হবে, আর রিফাইন্ড তেল এনো। লুচি করবো বেগুন ভাজা দিয়ে সঙ্গে গুনে গুনে ছটা দানাদার এনো, তোমার তো আবার সুগার, আমাদের তিনজনের মতো।
ধুর, দিলে তো মুডটাই নষ্ট করে, আজ এই নেই তো কাল সেই নেই, কি আশ্চর্য, দাও বাজারের ব্যাগ টা দাও আমি ঘুরে আসি। আর মালতির কি হোলো ওরও কি বিবাহবার্ষিকী নাকি? আগে থেকে বলোনি কেন ওকে, এই আস্কারা দিয়েই মাথায় তুলেছো এদের। শোনো সুমেধা আজ দুপুরে কোনোরকম রান্না করো, রাতে কিন্তু হোটেলে গিয়ে খাবো, বুঝলে আমি আসি তাহলে চট করে বাজার থেকে। আর হ্যাঁ, দুপুরে খেয়ে উঠেই পাইক পাড়া যাবো ঘুড়ির লড়াই দেখতে, ঘুড়িও ওড়াবো, আমার এক অফিস কলিগ সব ব্যবস্থা করে রাখবে বলেছে - ঘুড়ি, মাঞ্জা দেওয়া সুতো, সব টাকাপয়সা দেওয়া হয়ে গেছে সুমেধা, চলো দেখবে আনন্দ পাবে।
কি সব বলছো শুভ, আমি তো তোমায় সারপ্রাইজ দেবো ভেবেছিলাম, নাগের বাজারে ডায়মন্ড প্লাজায় Barbeque nation এ টেবিল ও বুক করে রেখেছি।
ঠিক আছে পাইক পাড়া থেকে কত আর দূর সুমেধা, ফিরতে ফিরতে না হয় রাত হবে, ঠিক আছে আসি তাহলে।
যায় তাহলে তাড়াতাড়ি স্নান করে পূজোটা সেরে নিয়ে তারপর না হয় রান্না বসাবো, (ইসস দুধ আনতে বলাই হোলো না পায়েস টা করবো ভেবেছিলাম)। মলি তাড়াতাড়ি স্নানটা সেরে নে, আমি আসলেই তুই করে নিস, শুনলি তো বাবা বলছে দুপুর দুপুর বের হবে।
মা তুমি আর বাবা যাও আমি যাবো না, এমনিতেই আমার মাথা খারাপ লাগছে কানাডায় কোন ইউনিভার্সিটি পাবো কিনা জানা নেই , আমার পছন্দের ইউনিভার্সিটি না হলে যাবোই না। আর আমার ওসব ঘুড়ি টুরি ওড়ানো ভালো লাগে না মা, বাবাকে আমি না বলতে পারবো না, তুমি বলে দিও।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া করেই শুভ আর সুমেধা সোজা রওনা দেই পাইক পাড়ার উদ্দেশ্যে।
সুমেধা কেন যাচ্ছি বলো তো তোমায় নিয়ে, মনে পরে এই ঘুড়িই তো ছিল তোমার আমার প্রেমের আকাশ ঘটক। উফফ ঘুড়ি কে নিয়েও তো আমরা কত লিখেছি। একটা সময় ছিল বিয়ের প্রায় দু তিন বছর পর্যন্ত তোমার আমার এত সখ ছিল যে আমরা ঘুড়ি কালেকশন করতাম। বাড়িতে টাঙিয়ে রাখতাম, আর মেয়ে হওয়ার পরে আসতে আসতে তা কমে গেলো। জানো, আজ সেই পুরানো স্মৃতিচারণা করতেই তো তোমায় নিয়ে আমার যাওয়া। মেয়ে কেন যাবে, ওর কি আর ভালো লাগবে, যাক এখনো প্রেমে হাবুডুবু খায় নি তাই, খেলে বুঝতে পারতো, ও আমাদের সাথে ঘুড়ির মাঠে যেত।
সে আর বলতে, তখন বোধহয় ক্লাস সেভেনে পড়ি, শীতকালের দুপুর আমি কাকিমা, মায়েদের সাথে ছাদে উঠেছি, আর বাবা, পাড়ার কাকুরা ছাদের একপাশে বসে তাস খেলছিল। তুমি আমায় ছাদে দেখে
অমনি তোমার সেই পেটকাটি ঘুড়িটা এমন গোত্তা মেরেছিলে আমাদের ছাদের উপরে, পড়বি তো পড় একেবারে বাবার হাতে তাসের উপরে।
কাকুরা তো সমানে বাবাকে দেখে হেসেই যাচ্ছিলো কারণ বাবা আচমকা ভয় পেয়ে গেছিল। বাবা ভেবেছিলো আকাশ থেকে কোনো পাখি বাবার কোলে এসে পড়েছে, আর বাবা লাফ মেরে উঠতে গিয়ে সে কি অবস্থা, পরনের লুঙ্গিটাই খুলে গেছিলো,
কোনো ভাবে নিজেকে সামলে তোমার ঘুড়ি টা রাগে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিলো, মনে পড়ে ? আর তোমার লেখা ছোট্ট চিরকুটটা যেটা তুমি আঠা দিয়ে ঘুড়িতে সাঁটিয়ে দিয়েছিলে, লেখা ছিল “ আমি তোমাকে ভালোবাসি- “। ভালোবাসি লেখা টুকরোটা বাবার হাতে আর” আমি তোমাকে “ লেখাটা বিজয় কাকুর হাতে, সে কি অবস্থা ! মা ছিল ভাগ্যিস কোনোভাবে সামাল দিয়েছিলো। আমি তো ভয়েই নিচে চলে গিয়েছিলাম।
সুমি তোমার নিজেরটা বলো? তুমি তো তারপর থেকে রোজ একই সময়ে ছাদে আসতে । আমি রোজ তোমায় চিঠি দিতাম ঘুড়ির মারফত আর তুমি সমানে তার উত্তর দিতে ভাতের আঠা লাগিয়ে স্টিকার করে ঘুড়ি মারফত। আর তোমার বাবারা, সেই যে ছাদ ছাড়লেন আর কোনোদিন উনি ছাদে আসেন নি, তাস খেলতে, ভয়ে। আচ্ছা সেই জন কাকিমা কে মনে পড়ে আরে মেরির মা, আরে বাবা, ওরা খ্রীষ্টান ছিল মনে নেই? তোমাদের বাড়ির ঠিক পশ্চিমে তোমাদের লাগোয়া পাড়াতেই তো থাকতেন। গরম কাল ছিল, দুপুরে ঘুড়ি ওড়াচ্ছি, তুমি তোমার বাড়ির ছাদে আমার ঘুড়ির অপেক্ষায়, ঘুড়িটা তখন গোত্তাই এসেছে তোমার মাথার উপর, এমন সময় হওয়ার দিক পরিবর্তন হঠাৎ করে সেই ঘুড়ি পড়লো ছাদে মেলা জন কাকিমার ভেজা সেমিজের উপর। ঘুড়ি তো জলে চুপসে শেষ, আর চিরকুট টা বোধহয় জনকাকিমার সেমিজে।
যাক সেটা অবশ্য দূর থেকে দেখি নি। আমি তো ভয়ে লাটাই থেকে সুতোটা ছিঁড়ে দি, কারণ জন কাকিমাতো বুঝতে পারবেন, তাই সুতোর মধ্যে একটা ঢিল বেঁধে সেটা ছুঁড়ে দিয়েছিলাম ঝগড়াটে রতন কাকুর ছাদে। তারপরের ঘটনাটা তো জানোই রতন কাকু আর জন কাকিমার ঝগড়া কোথায় পৌঁছেছিল, ঘুড়ি এমন একটা জিনিস। দেখতো, দেখতে দেখতে পৌঁছেও গেলাম পাইক পাড়ায়, কি সুন্দর লাগছে সারাটা আকাশ, উফফ ! কি অপরূপ দৃশ্য আকাশের সুমি তাই না? জানো এই ঘুড়ি দিয়ে এখানে বাজী রাখা হয়, পুরোটাই টাকার খেলা। উত্তর কলকাতার এটা একটা বেশ বনেদি ঐতিহ্য ঘুড়ি ওড়ানো।
এত বছরের পুরোনো অভ্যেস, দেখো তাও পারছি, ইসস ধরো ধরো, আরে ধরবে তো লাটাইটা সুমি? , ইসসস , মুহূর্তে ভোকাট্টা করে দিলো মোমবাতি ঘুড়িটা। দেখেছো ঘুড়ি হোলো এমন একটা জিনিস কিছু বোঝার আগেই ছো মেরে কেটে দিয়ে চলে যায়,ঠিক যেমনটা আমি তোমায় ছো মেরে নিয়ে বিয়ে করতে চলে গেছিলাম সুমেধা। আর পারছি না, বেশ বেলা হোলো চলো যাওয়া যাক। অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে, বুঝতে পারছি বয়স যে হচ্ছে, তাই তার সাথে সাথে দমটাও ফুরোচ্ছে। এই শোনো গিয়ে গিয়েই খেয়ে নেব বেশ খিদে পেয়েছে, আমাদের বিবাহবার্ষিকীটা কিন্তু ভালোই গেলো কি বলো, সারাটা দুপুর থেকে আমাদের সঙ্গী হয়ে থাকলো ঘটক ঘুড়ি। তুমি তো বলছিলে টেবিল বুক করে রেখেছো? শোনো, একটা ঘুড়ি নিয়ে এসেছি গাড়িতে আছে , হোটেলে গিয়ে ওয়েটার কে বোলো তো ঘুড়ির সাথে তোমার আমার একটা ফটো তুলে দিতে। সুমেধা বিয়ের দিনটা মনে পড়ে, আজ এই নিয়ে কুড়িটা বছর হয়ে গেলো। আমাদের বৌভাতে সবাই তো রিসেপশনের জায়গাটা দেখে অবাক -নানান ধরণের ঘুড়ি। কোনোটার নাম পেটকাটি, আবার ময়ূরপঙ্খী, চৌরঙ্গী, লেজঝোলা, মোমবাতি আর দোবাজ। এমনকি খাওয়ার দাওয়ারের মেনু ও হয়েছিল ওই ঘুড়ি গুলোর নামে, কি করে ভুলি ওদের, ওরাই তো ছিল আমার আর সুমেধার ঘটক। সবাই কত জানতে চেয়েছিলো কেন ঘুড়ি? সবাইকে কি করে বলি একই গল্প তাই আজ বলছি, যারা বিশ বছর আগে আমায় জিগ্যেস করেছিলেন বিয়ের দিনে, তাদের বলি ঘুড়িও কিন্তু কথা বলে, আকাশে উড়ে ওরাও কিন্তু মেলবন্ধন ঘটায়,শুধু সম্পর্ক কাটতে ওরা আকাশে ওড়ে না, আজ ঘুড়ি না হলে আমার আর সুমেধার গল্পটা অসম্পূর্ণ থেকে যেত।
Comments
Post a Comment
always