B-10 #SURVIVE বাঁচবো
বাঁচবো
না রিপোর্ট টা ভালো নয়, ডাক্তার যেটা সন্দেহ করছিলো সেটাই ঠিক। কি করে বলি, থাক মানে মানে সব কিছু চুকে যাক আর তো কটা দিন বলতে তো হবেই, না বললে ট্রিটমেন্ট টাও তো শুরু করি কি করে।
মা, তুমি এখনোও শোবে না, অনেক তো রাত্রি হোলো। মা টেবিল লাইট টা অফ করো না, আমি যে ঘুমোতে পারছি না।
তুই ওপাশ ফিরে শুয়ে পড় , আমি একটু দশকর্মার ফর্দ টা মিলিয়ে নি। আর তো বিয়ের কটা দিন বাকি, ভাবছি টাকা পয়সায় সব কুলোবে তো। কাল তো ক্যাটারিং এ অ্যাডভান্স দিতে হবে, লাইট আছে, বাদ্দযন্ত্রওয়ালারা আছে, আত্মীয় স্বজন আছে, লোকজন খাওয়ানো আছে, সুমেধা হয়ে যাবে তো, বল। কিরে শুয়ে পড়লি নাকি?
না মা শুইনি, আমিও ভাবছি, আচ্ছা দাঁড়াও আসছি। ভাবলাম তুমি একটু ঘুমোবে, সারাটাদিন কতই পরিশ্রম করো, তাই আমিও ঘুমোনোর ভান করছিলাম।আচ্ছা মা জানি তো সবই, তাও জিজ্ঞাসা করছি আর কি? বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাগুলো আর কি পাওয়া যাবে না? মা খরচ গুলো একটু কমানো যায় না, অতো লোক খাওয়ানোর কি আছে মা? আজকের দিনে তুমি খাওয়ালেও বদনাম করবে, আবার না বললেও বদনাম করবে তাতে বলি কি মা নেমন্তন্ন টা পুরোপুরি বাদ দিলে হয় না?
সুমেধা মা, আর কত স্যাক্রিফাইস করবি বলতো, সেইতো ছোটোথেকেই করে চলেছিস। দূর্গাপূজোতে জামা কিনতে চাইলে সব থেকে কম দামি জামাটাই কিনতিস, তখন তো বাবার ভালোই সামর্থ্য ছিল সুমেধা? বললেই বলতিস রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত উক্তি “ তাহারা আপনার সন্তানকে উত্তম জামা কাপড় পরাইতেন , অন্যের সন্তানের মুখ ভার করাইবার জন্য “। জানিস সুমেধা ছোটো থেকেই তোর এই কথাটা এত কানে লেগে আছে, আর তুইও এত ভিতরে নিয়েছিলি কথাটা ! মারে এবার তো আমাদের সময় হয়েছে তোর জন্য কিছু করার।
তুই ওসব ভাবিস না বাবা, তোর বাবা গ্রাচুইটির যে টাকাটা পেয়েছেন সেখান থেকেই তো তোর বিয়েটা হয়ে যাবে। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটা আর পেনশন দিয়ে আমাদের ও ভালোভাবে দিব্যি চলে যাবে।
মা তুমি কিন্তু সত্যিটা বলছো না। আমি সব জানি তুমি লুকোচ্ছ। মা শুনেছি ছেলের বাড়ি খুব পয়সাওয়ালা, পারবো তো মা তুমি তো জানো আমি খুব কিপটে, একেকটা পয়সা হিসেব করে খরচা করি। কেন গো এত তাড়াতাড়ি আমায় বিয়ে দিলে মা, আমি কি ভার হয়ে গিয়েছিলাম তোমার আর বাবার। একটু তো বয়সটা বাড়তে দিতে, তা বলে একেবারে পঁচিশে। মা ইচ্ছে ছিল জানো ssc পরীক্ষা দেবো, বা ব্যাংকের পরীক্ষা গুলো দেবো, তারপর যদি বিয়ে দিতে ভালো হত না? আসলে তোমরাও বুঝেছিলে আর হবে না তাই না মা, জিজ্ঞেস তো করতে পারতে ? তুমি আর বাবা তোমাদের সময়ের সাথে আমায় মিলিয়ে দিয়েছো তাই না। ঠিক আছে মা দোষ দিচ্ছি না বা দেবও না। মা চলো না শুয়ে পড়ি, আস্তে কথা বলো বাবা আবার উঠে পড়বে। কাল না হয় তুমি আর আমি চিলেকোঠার ঘরে বসে হিসেব নিকেশ করবো।
আহঃ হচ্ছেটা কি তুমি আর সুমেধা সমানে বকবক করে চলেছো, আমার একে তো ঘুম হচ্ছে না তারউপর বমি পাচ্ছে। হজম হয়নি মনে হচ্ছে, তোমরা মা মেয়ে একটু চুপ করবে প্লিস, তোমাদের কথায় আমার মাথা ঘুরছে।
আরে ও তোমার মনের ভুল, ঘুম হয়নি তো তাই। ঠিক আছে চল শুয়ে পড়ি, শুতে শুতে কথা বলবো।
শোন মা আর তো গুনে গুনে কুড়িটা দিনও নেই, কাল তোকে নিয়ে গয়নার দোকানে যাবো। তোর মানতাসা খুব পছন্দ তাই তোর মাপ দিয়ে একেবারে কালই কিনে নিয়ে আসবো বুঝলি।
মা কি দরকার আজকাল ওগুলো পরা যায় নাকি। দেখোনা চারিদিকে যা অবস্থা, শুধু শুধু ওগুলোতে আর খরচ কোরো না, আমি তো যেতেই পারবো না।
ঠিক আছে যা বুঝিস। কাল তাহলে তোর বাবাকে একটু ডাক্তার টা দেখিয়ে আনবো বড্ডো শরীর টা খারাপ যাচ্ছে এই কদিন।
মা কাল না হয় তুমি বাবাকে ডাক্তার দেখিয়ে আসার পর আমি বের হবো। বন্ধুদের বাড়িতে যাবো আর হ্যাঁ একটা কাগজে সই লাগবে তোমার, আমি একটা ppf একাউন্ট করবো তোমার সাথে আমার। তাহলে লোকজন নেমন্তন্ন টা কম করছো তো নাকি?
এই শোন্ সকালে তাহলে তাড়াতাড়ি বের হোস , আর হ্যাঁ বিকেলে আজ ছেলের বাড়ি থেকে ফোন এসেছিলো কাল ওর কাকিমা আসবে গাড়ি নিয়ে।। তোকে রেডি থাকতে বলেছেন, তোর বেনারসী কিনতে যাবেন বলেছেন , শুভ একেবারে অফিস থেকে চলে যাবে গাড়িয়াহাটে ট্রেডার্স এসেমব্লি তে। কি রে শুয়ে পড়লি? হুঁ।
মা কাল রাতে তুমি কি কি বললে আমি সবই শুনেছি। দেখি চট করে এই কাগজটা সই করে দাও তো। তুমি তাহলে বাবাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ঘুরে এসো আমি চটপট রান্নাটা সেরে নি। উফফ দেখি কার ফোন বাজছে? মোবাইলে করতে পারে, সেই ল্যান্ড ফোনেই করবে।
হ্যালো, হ্যাঁ শুভ শুনছি, বলো কি ব্যাপার, এত সকাল সকাল? বিকেলে দেখা হলে তো বলতে পারতে, আচ্ছা বলো।
আরে, অফারটা টা তো আর বিকেল পর্যন্ত থাকবে না, আসলে হনিমুন এ সিঙ্গাপুরে যাবো ভাবছি, তাই তোমার মতটা জানতে ফোন করলাম।
আপত্তি নেই, তবে হ্যাঁ, চারটে টিকিট কোরো। আর ওই দুটো টিকিটের টাকাটা আমার থেকে নিয়ে নিয়ো কেমন? না নিলে বিকেলে আমি কিন্তু মোটেই যাবো না।
ঠিক আছে, নেব ক্ষণ। কি নামে হবে সেটা তো বলবে? আমার মা আর বাবার নামে, কেন কোনো অসুবিধে আছে? আচ্ছা হ্যাঁ refundable কোরো কিন্তু, রাখি। তাহলে বিকেলে তো দেখা হচ্ছেই ।
কে রে শুভ নাকি?
হ্যাঁ ফোন করেছিলো। হনিমুন এ সিঙ্গাপুর যাবে, তাই বললাম তোমার আর বাবার টিকিটটাও কাটতে।
কি সব বলছিস? তোর বাবাকে নিয়ে যা, আমি মোটেই যাবো না। হনিমুনে তাও আবার তোর বাবা আর আমি নতুন জামাই এর সাথে, যতসব আদিখ্যেতা, আমার প্লেনে উঠলে বমি হয়। দেখবি জামাইয়ের সামনেই বমি করে দেবো সেটা ভালো হবে। আচ্ছা কবে যাবি ঠিক করলি? দ্বিরাগমনের পরের দিন করিস।
যাক বিয়েটা মোটের উপর ভালো ভাবেই হয়ে গেলো। আমার স্বামী নামে মানুষটা এখনো যা দেখলাম খারাপ নয়, বছর তিন চারেক তো লাগবেই পুরোটা বুঝতে। তবে হ্যাঁ, শ্বশুর বাড়িটা ভালো, দুজনেই উনারা সারাদিন চুপ থাকেন। সারাদিন লেখালেখির মধ্যে কাটে উনাদের, তাই এ বাড়িতে কথা কিছুই শোনা যায় না। বাইরে থেকে লোকে বলবে এ বাড়িতে বুঝি লোক থাকে না।
মা,
আজ বহুদিন পরে তোমায় লিখছি, জানি তুমি নেই তাই এই চিঠিটা আমার ডায়েরী তে স্মৃতি হয়েই থাকুক।
যেদিন আমি দ্বিরাগমনে এলাম তুমি আমায় চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে গিয়ে কত কথা জিজ্ঞাসা করেছিলে। মা সেই রাতে তুমি দশকর্মার ফর্দ করছিলে না, বাবার অসুখের কত টাকা লাগবে তার হিসেব করছিলে, জানো তোমার হাতের লেখার সমস্ত কাগজ গুলো তুমি ভুল করে আমার ব্যাগে রেখেছিলে। আমি ফুলসজ্জার রাতে কানের দুলগুলো রাখার সময় তোমার লেখা গুলো পেয়েছিলাম। আজও ভাবি মা তুমি পুরোটাই লুকোতে পারলে? যাক দ্বিরাগমনের দিন আমার টিউশন থেকে তিল তিল করে জমানো টাকা তোমার নামে রেখে এসেছিলাম বাবার ট্ৰিটমেন্টের জন্য। আর হ্যাঁ, রেকারিং এর কাগজ টা রেখেছিলাম তোমার ব্যাগে। ইচ্ছে ছিল প্রতি মাসে সেখানে টাকা রেখে যাবো, বাদবাকি জীবনটা তোমাদের স্বাচ্ছন্দ্যে চলে যাবে। কিন্ত মা একথা গুলো তোমার কাছে বলাই হোলো না, দ্বিরাগমনের দিনে তুমি চিলেকোঠার ঘরে প্রচন্ড বুকে ব্যাথা নিয়ে কিছু বোঝার আগেই চলে গেলে। জানো মা আমার সিঙ্গাপুরে যাওয়া আর হোলো না। তোমার কাজকর্ম হওয়ার পর ওর অফিস join করে প্রায় আটমাস পর আমরা যায় বাবাকে নিয়ে একসাথে। মা প্লেন টা যখন মাঝ আকাশে তখন বমি পাচ্ছিলো, আমি ভাবছিলাম প্লেনের জানালা থেকে ওই নীল আকাশের মেঘের মধ্যে হয়তো তুমি আছো, বলতে চেয়েছিলাম, মা তুমি দিদা হতে চলেছো।
সেই তো একই পথে যাচ্ছিলাম, আর বমি আসলেই তোমার কথাগুলো মাঝ আকাশে মনে পড়ছিলো “হনিমুনে ; তাও আবার তোর বাবা আর আমি নতুন জামাইয়ের সাথে যতসব আদিখ্যেতা, আমার প্লেনে উঠলে বমি হয় “। ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হয় শুনেছি, তার প্রমান ও তো পেলাম আমার যাত্রাপথে।
মা সবসময় কেন পাশা পাল্টে যায়, শুধু আমার ক্ষেত্রে বলছি না সবার ক্ষেত্রে অমনটা হয় কেন? না বলতে পারা কথা গুলো কেন অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। বাঁচতে চেয়েছিলাম সবাইকে নিয়ে মা বাঁচলাম ও কিন্তু বাঁচার স্মৃতি নিয়ে।
Comments
Post a Comment
always