B4 :- চতুর্থী

#চতুর্থী

মা আজ তোমার চতুর্থীর কাজ করছি?  অনেক অজানা জানা কথা গুলো তোমায় বলতে চাই, মা। তোমার রোগের খবর পাওয়া মাত্র তড়িঘড়ি বিয়ে দিয়ে দিলে, নিজে দায়মুক্ত হলে, আমাকে পাঠিয়ে দিলে সংসার জীবন করতে তাও আবার সুদূর দিল্লিতে। হয়তো দেখে যেতে চেয়েছিলে, তাই তোমার বাবার এই চিন্তাধারাকে আমিও মেনে নিয়েছিলাম আবার ঈশ্বরের এক অসীম কৃপায় এই ঘাটশিলাতেই ছেলেও পেয়ে গিয়েছিলে। মামা বলেছিলো, মা মনে আছে তোমার?  তোর মেয়ের বিয়ে ঘাটশিলাতেই হবে, সেটা মিলেও গেছিলো কেমন করে। আসলে মামার কথাগুলো তোমরা প্রথমে অগ্রাহ্য করলেও তোমরা মনে মনে মানতে, কোথাও না কোথাও তার কথা গুলো মানতে। মা এখন সকাল নটা বাজে, আশীষ পুরোহিত এসেছে, তোমার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের মন্ত্র পাঠের জন্য আজ যে আমার চতুর্থী।

একটা কথা বলি মা?  যদি বিয়েটা না হত তবে তো বাবার সাথে আমিও এগারো দিনেই তোমার কাজটা করতাম তাই না?  অন্যের বাড়ি, মানে শাস্ত্র মতে গোত্রান্তর হয়ে গেছে তাই তো মা?  আচ্ছা মা মেয়েরা জীবনে কি শুধুই ধাক্কা খেতে খেতে বড় হয়?  ওরা কি কখনো কারোরই হয় না? তাই কি অধিকার চার দিনের?  যাক সে সব কথা চোখের কোনে জল এসে চিক চিক করছে, আর বেশি ভাবলে তোমার কাজটা হয়তো ঠিকমতো করতেও পারবো না, আসলে কি বলতো মা মেয়েদের বেশি কাঁদতে নেই, আসলেও সেটা একান্তে বাথরুমে,  তা না হলে স্বামী নামে মানুষটা এক্ষুনি বোলবে আমি তো আছি, একটা ভরসার হাত বাড়িয়ে দেবে, আর মুহূর্তে তোমার হাতটা ছেড়ে তার হাত ধরে, মনে সাহস এনে এগিয়ে যাবো, বসবো তোমার কাজ করতে। মা আজকাল আমিও বেশ বোঝদার হয়েছি,  আগের মত নই। মনে পড়ে বেশ বড় হয়ে যেদিন মামা মামীর কাছে শুনলাম তোমাদের বিয়ে সেটা প্রেমের বিয়ে , হাতপা ছড়িয়ে বেশ মনের সুখে কেঁদেছিলাম। সমানে বলেছিলাম এতকাল বলোনি কেন?  আর তাতে তুমিও কি লজ্জা পেয়েছিলে মা !
সামনেই আসতে চাও নি,  বাবা তখন দাঁড়ি কামাচ্ছিলো, বেশ মনে আছে, একটা গম্ভীর গলা, আবার ঠোঁটের নিচে হাসি, সেটা চেপে বলেছিলো তুই বোকা যে বোকায় রয়ে গেলি। ওটা অনেকেই তো করে, বলার প্রয়োজন মনে হয়নি তাই বলিনি, এগুলো কি আর বলার কথা বাবা। মা এখন মনে হয় সেদিন তোমায় বেশ লজ্জায় ফেলেছিলাম, আমার ভুল ছিল মা আমায় ক্ষমা করে দিয়ো। মা আমি তোমার ফটোর সামনে বসে ভাবছি,  কি মিষ্টি তোমায় লাগছে জানো মা? কন্যাকুমারী যখন বেড়াতে গিয়েছিলাম, মামা ঐ ফটোটা তুলেছিল, আমি তখন বোধহয় সবে কলেজে পড়ি, পেছনে বিবেকানন্দ রক, তিনসমুদ্রের মিলন স্থল আর ঠিক মাঝখানে তুমি দাঁড়িয়ে, আজ মনে হচ্ছে তোমার দেহাবশেষ অস্থি টা বুঝি ঐ সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা মা তোমার এই ছবিটা তো কতবার দেখেছি তাই না?  কোনোদিন কি ভেবেছিলাম এটাই একদিন ফটো হয়ে, চতুর্থীর দিনে আমার কাজে আসবে। আসলে কি বলতো মা আমরা প্রতিনিয়ত ঘুরতে গিয়ে কত ফটোই না তুলি আমাদের, আর ঠিক সেখান থেকেই বেছে স্থান পায় কোনো ফটো, ওটা যেন তোলা থাকে একেবারে অলক্ষ্যেই ,  তখন কিন্তু মা বিন্দুমাত্র বুঝি না ওটারও একটা মূল্য আছে, শুধু অপেক্ষা কোনো এক সময়ের। মা আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ পাঠিয়েছে ওটা পড়েই তোমার কাজে বসেছি, মামারাও দিয়েছে সেটা স্নান করে উঠে পড়েছিলাম ,  বাবাকেও দিয়েছে, সেগুলো বাবা ঘাট কাপড়ের দিনে পড়বে। আচ্ছা আর দুটো কথা বলে তোমার কাজে বসছি মা।

প্রথম যেটা সেটা হোলো তুমি তো দেখেই গিয়েছিলে কোরোনার জন্য কত কড়াকড়ি তাই সেদিন মাত্র পনেরো জনের ব্যবস্থা করতে হয়েছে, মানে খাবারের, একমাত্র শ্মশান বন্ধু যারা। আজ ছোটো পিসি ফোন করেছিলো মেদিনীপুর থেকে,  সমানে কেঁদেই চলেছে, কথাই বলতে পারছে না। ছোটো পিসি বলাতে মনে পড়লো তোমায় কোনোদিন বলা হয়নি, আসলে আমায় বারণ করেছিলো। ছোটো পিসি থাকতো তোমাদের সাথে আমি তখন বেশ ছোট্ট ক্লাস ওয়ানে পড়ি। আমার নার্সারির ক্লাসের পেন্সিল দিয়ে লেখা খাতা গুলো ফেলে দিত না,  বরং তার উপরে পেন দিয়ে পিসি কলেজের নোটস লিখতো পরে সেটা রবার দিয়ে মুছে দিত, কোনো সময় বাবাকে বলতো না খাতা কিনতে হবে তার ভয়ে, এমনিতেই গ্রামের মেয়ে, দাদা বৌদির সংসারে এসে কলেজে ভর্তি হয়েছে আর কত চাপ দেবে তাই চিন্তা করে, কোনোদিনও সাহস করেনি,  পিসি বোধয় ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলো তাই না মা। কত কষ্ট করে পড়াশুনো করে পিসির আবারো বিয়েই হোলো সেই গ্রামেই, এটাই হয়তো কপাল বা ভাগ্য। তবে হ্যাঁ ছেলে দুটো কিন্ত মানুষের মত মানুষ হয়েছে, ছোটো ছেলেটা তো IIT চেন্নাই এ পড়ে,  কে বোলবে ওরা গ্রামের পরিবেশে বড় হয়েছে, আর কিছুদিন পরে হয়তো তারা দেশ দেশান্তরে ঘুরবে। ওরা কিন্ত এখনো ওদের স্বাভাবিকত্ব হারায় নি গ্রামে গেলে বাবার সাথে লাঙ্গল ধরে,  ডাব গাছে উঠে ডাব পাড়ে, আবার চেন্নায়ের পাঁচতারা হোটেলে গিয়ে কাঁটা চামচ দিয়ে খাওয়ার ও খায়। পিসি তো আজ ফোন করে সেটাই বলছিলো যে ,  বৌদি আমার কাছে মায়ের মত, বৌদির আশীর্বাদেই তো আমার ছেলে দুটো মানুষ হয়েছে তাই ওরাও আজ তোমার জন্য কাজ করছে চতুর্থীর,  গ্রামের বাড়িতে মা। আচ্ছা আবার কাজ হয়ে যাক পরে কথা বলছি,  এরপর তো আবার আমাকেও তো চলে যেতে হবে দিল্লিতে ।
মা কাজ হোলো খুব ভালো ভাবে, তবে হ্যাঁ একটা জায়গায় বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। ব্রাহ্মণ তো সমানে মন্ত্র উচ্চারণ করছিলেন সংস্কৃতে, অবশ্য মাঝে মাঝে তার বাংলা মানে টাও বলে দিচ্ছিলেন। একটা জায়গায় উনি বলেন” আজ থেকে মা তোমার সাথে আমার ইহলোকের সম্পর্ক শেষ করছি, তুমি বৈতরণী পেরিয়ে পরলোকে গমন করো “ তার পর একটা সুতো দুই হাত দিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেললাম। ওটা মানতে পারিনি মা।  
আজও মনে পরে এই তো সেদিন এপ্রিল মাসে, দিল্লি থেকে তোমায় ফোন করেছি, তুমি বললে তোর বাবা বেরিয়েছে কারেন্ট নেই, ইনভার্টার টা চলতে চলতে বন্ধ হয়ে গেছে, সকাল থেকেই কারেন্ট নেই,  তাই অন্ধকারে বসে ভাবছি তোদের কথা, একটা নাতি নাতনি হলে তাদের দেখেও যেতে পারতাম।  এই তো আমার কাজের মেয়েটা বড় দুঃখী সে, স্বামী তাড়িয়ে দিয়েছে, তাই লোকের বাড়িতে কাজ করে, ওর বাচ্চাটাকে নিয়েই এখন আমার পৃথিবী ।  জানিস বাবা ওকেই আমি নাতি বানিয়েছি, তোরা তো প্ল্যানিং ই করে গেলি তাই ও স্বাদটা আমার এজন্মে অপূর্ণ রয়ে গেলো।


আরেকটা কথা ভাবছি জানিস বাবা কেউ চলে গেলে শুনেছি সে আবার আসেও, আমি কিন্ত তোর ছোটো  মাসি, দাদু দিদাকে কত দেখতে চেয়েছি কোনোদিন দেখতে পাই নি। আমার তো ক্যান্সার,  আমি তো সামান্য দিনই আছি, আমি কিন্ত নিশ্চয় আসবো? দেখবি ছাদে ঘুরবো,  বাড়ির সামনে বাগানে হাটবো,  তোর বাবা তো রুটি বানাতে পারে না, আকারে ইঙ্গিতে সেটাও শিখিয়ে দেবো, তবে হ্যাঁ খুব মজা করে বাকি দিনগুলো কাটাস মা, একেবারে আমার মত হাসি খুশি হয়ে। 
                     কি বলতে চাও তুমি মা তুমি এসো না, আমি তো তোমায় দেখে ভয় পেয়ে যাবো। শেষ একটা কথা বলি মা,  তুমি এসেছিলে? আচ্ছা শোনো যদি এসেই থাকো তাহলে তোমার পছন্দের একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত তোমায় শোনাই । গানটার ঐ দুটো লাইন আমার বেশ মনে দাগ কাটে “ সে চলে গেলো বলে গেলো না, সে কোথায় গেলো ফিরে এলো না, তাই আপন মনে বসে আছি কুসুম বনেতে, সে ঢেউয়ের মত ভেসে গেছে চাঁদের আলোর দেশে গেছে “। 
মা, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী, একথাটার মানে ও দুঃখ টা ছোটবেলায় বুঝতাম না, আজ বেশ ভালো ভাবে অন্তর দিয়ে সেটা উপলব্ধি করছি,  আমার চতুর্থীর কাজ, আজ যে শেষ হোলো মা, তুমি ভালো থেকো, আমিও ও স্বামীকে, বাবাকে নিয়ে ভালো  থাকবো মা। 

Comments

Post a Comment

always

sadamata101.blogspot.com

B-47#বিশ্বকর্মা_পূজো

সন্তোষ ঢাকি

B-71#GANESH_PRASADAM. ( গনেশজির ভোগ নিবেদন মোদক ও পূরণ পুলি)