B-151# রুটি কলা থেকে বেড়ে ওঠা লালন- দ্বিতীয় ভাগ

আমার জীবনটা ছোটবেলা থেকেই কষ্টের বলবো না,বলতে পারি একটা ঘাত প্রতিঘাত থেকে ধাক্কা খেতে খেতে বড় হওয়া।বন্ধুবান্ধব কেউই বিশ্বাস করে না আর করবেই বা কেমনে আমি তো গরিব ঘর থেকে বেড়ে ওটা লালন যার কোনো চালচুলো সামনে পেছনে কেউই নাই, যেটা আছে শুধুই লাঞ্ছনা আর সবার সামনে পরিহাস।ক্লাস এইট পাশ করা এক শিশুর জীবন সম্বন্ধে কতটুকুই বা জ্ঞান? তবে মাঝে মাঝে মনে হয় এর থেকে বোধহয় কুকুর ছানার ও জীবন সুখের হয় লোকে অন্তত তাদের উচ্ছিষ্ট খাবার আদর করে ডেকে দেয়।
এই মনের কষ্টটা পেয়েছিলাম ঈদের দিনে। আমাদের বাংলাদেশে ঈদের সময় একটা লম্বা ছুটি থাকে টানা তিন চারদিন।তাই সেই সময় আমি হোটেলেই থাকতাম,বাইরে কোথায় যাবো?সবার আনন্দের মধ্যে আমার যাওয়া টা ঠিক নয়,আর এমনিতেই সমস্ত খাবারের হোটেল বন্ধ থাকে, খাবার কোথায় পাবো এমনকি আমার নিজের হোটেলেও না। এটা আগে থেকেই বুঝতে পেরে আমি বেশ কিছু "রুটি ও কলা" আমার সাথে রাখতাম।আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিন চারদিন পর আমি হোটেল থেকে বাইরে বের হতাম, ঈদের সময় একটা প্রায় বন্দী দশা কাটাতাম।আমাদের চুওয়াডাঙ্গায় বিশেষ কোনো হোটেল নাই দুই তিনটা ছাড়া। তাই চিড়া, মুড়ি, কলা রুটি এটাই ছিল আমার দৈনন্দিন খাবার  যা একটা প্রায় অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।
ক্লাস নাইনে ও একই জীবনধারা আগে যা ছিল, স্কুলে যেতে পারতাম না প্রায় মাস খানেক হোটেলের মালিকের সাথে একই অশান্তি স্কুলে গেলে হোটেল চলবে কি করে।এদিকে পরীক্ষার সময় হোলো সেই একই রকম হেডমাস্টারের সাথে অনুনয় বিনয় ও পরে অনুমতি পেলাম পরীক্ষায় বসার। রেজাল্ট পাবলিশ হোলো এবারে যেটা হোলো আমি অংকে ফেল করলাম।

হতাশা আরো বেড়ে গেলো স্যারেদের সহযোগিতা তো দূরে থাক একটা হাসির পাত্র হলাম সবার কাছে।একদিন স্যারের বাসায় গেলাম ।স্যারের নাম ছিল উজিৎ স্যার, বললাম -স্যার আমি তো অঙ্ক পারিনা আমারে যদি একটু অঙ্ক সেখান। স্যার নিজের জায়গায় ঠিক উনি বললেন তুমি তো স্কুলেও আসো না ক্লাস ও বিশেষ করো না তোমাকে আমি কি শেখাবো এমনিতেই তোমাকে স্কুল থেকে বার করে দেওয়ার কথা চলছে। একে তো মন খারাপ ছিলই,শুনে আরো খারাপ হয়ে গেলো।কিন্তু স্যারের কথাই কান না দিয়ে আমি স্যারের পায়ে পরে বললাম স্যার একবার বলেন আমি কেমন করে অংকে ফেল করসি। ঈদের ছুটিতে আমি তো সারাদিন পড়াশুনা করেছি তাও কেন ফেল করলাম। দেখলাম উনার  আমার অবস্থা  দেখে কিছুটা হলেও আমার প্রতি দয়া হোলো। আমায় বললেন তোমার অঙ্কের সূত্র কি মুখস্থ আছে, আগে ওগুলি মুখস্থ করো তার পর না হয় এসো। আমি বলি স্যার পুরা বইটাই মুখস্ত আপনি জিজ্ঞাসা করুন। স্যার যা জিজ্ঞাসা করছেন আমি সবটাই বলে ফেলি নিমেষে। এরপর আমাকে কিছু অঙ্ক দেন বই থেকে করতে সে গুলিও করে ফেলি মুহূর্তে। স্যার তো অবাক উনি বললেন তুমি ফেল করলে কি ভাবে একবার বলতো। আমি তো জানি আমার দুর্বলতাটা কোথায়। স্যার কে বললাম প্রথমত আমি অঙ্কের সূত্রের প্রয়োগ জানি না সেটা কিভাবে করতে হয় এটা প্রথম কারণ। দ্বিতীয় কারণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে প্রতিটা অঙ্ক ঘুরিয়ে আসলেই আমি করতে পারি না কারণ ঈদের সময় আমি পুরা বইটাই মুখস্থ করে ফেলেছি । আমি ভাবতাম ইতিহাস যেমন মুখস্থ করতে হয় অঙ্কটাও তেমন মুখস্থ করতে হয়। আমাকে তো কেউই কোনোদিন বলেনি কিন্ত মন বলতো অঙ্কটা বোঝার জিনিস মুখস্থ করলে হবে না। সেটা জানবোই বা কেমন করে ক্লাসে তো যেতে পারতাম না স্যার।হোটেলের কাজ সেরে সকাল আটটা হয়ে যেত স্কুলে যেতে আর প্রথম ক্লাসই তো ছিল বেশিরভাগ দিন অঙ্কের।তাই সেই ক্লাস আমার করা হতো না।স্যার একটা কথা বলি,জানেন ফেল করার পরে কতজনার কাছে গেছি আমার ভুলটা কোথায় বন্ধু বান্ধব, দাদাদের কাছে প্রত্যেকে একই কথা অঙ্কের সূত্র মুখস্ত করো। মনে জেদ চাপলো আর আমি অঙ্ক শুধু মুখস্ত নয় ঠোঁটস্থ করে ফেলি  প্রায় অর্ধেক বইটা।শুনে স্যার হাসলেন বললেন পড়াতে পারি তবে তোমায় ক্লাসে আসতে হবে। এইভাবে প্রাইভেট পড়ালে তাহলে স্কুলের প্রয়োজনীয়তা টা কোথায়?সবাই তো প্রাইভেট পড়েই পাশ করে যেত,এতকাল কোটি কোটি টাকা খরচা করে সরকার স্কুল কেন বানায়।স্যার সম্মতি দিলেন পড়ানোর কিন্ত বললেন তুমি বিকেলে আসো, আমি বললাম স্যার আমি তো ঐ সময় হোটেলে কাজ করি কি ভাবে সম্ভব। সকালেও সম্ভব নয় স্কুল আছে।তাহলে তুমি একটা কাজ করতে পারো ফজরের নামাজের পরে আমি বাড়ির নিচেই থাকি উপরে উঠি না তখন এসো আমি খুব একটা বিশ্রাম করি না।আমি  গেলাম, স্যার আমাকে আদিলের টেস্ট পেপার থেকে অঙ্ক দিলেন আমি চটপট করে ফেলি,স্যার ও অবাক। আমি তখন স্যারকে বলি স্যার অঙ্কের এমন কোনো বই নেই যে আমি মুখস্থ করিনি কিন্তু ঐ যে বুঝি না আর প্রশ্ন পত্র ঘুরিয়ে আসলেই আমি আর অঙ্ক করতে পারি না।  ওটাই আমার দোষ আগেও যে একই কথা বলেছি।আমি বললাম স্যার আমার সমস্যা অঙ্কের সূত্রের সঠিক প্রয়োগ আমি জানি না কোন অংকের কি সূত্র সেটাই তো জানা নেই।স্যার আমায় শেখাতে শুরু করলেন টানা পনেরো দিন হবে আমার অঙ্কটা আয়ত্তাধীন হোলো পুরোদস্তুর। আমি অঙ্কটাকে ভালোবাসতে শুরু করলাম। স্যারের ও খুব ভালো লাগলো এত অল্পদিনে আমি অংকে পটু হয়ে গেলাম। এরপর স্যার আমাকে তাঁর ছাত্রদের পড়াতে বলেন উনার এতটাই বিশ্বাস ছিল আমার উপরে।মনে এতটাই আনন্দ হোতো সেটা বলার নয়,আমি 
পারি সব অঙ্ক পারি নিজের প্রতি একটা বিশ্বাস জন্মালো। এমন ও গেছে টানা তিনদিন খাওয়া হয় নি কিন্তু অঙ্কটা ছিল আমার খাওয়া ওটা মনের খাওয়া, তৃপ্তির খাওয়া। যে সময় আর পারতাম না আমার ব্যাগ থেকে রুটি কলা বার করে খেয়ে ফেলতাম। এই খাওয়াটা বেশির ভাগ সময়ে খেতাম বিকেলে নামাজের পরে ঠিক সন্ধ্যে হওয়ার পর। কারণ একটাই তাহলে পেটটা ভরা থাকতো সেটা পরের দিন বিকাল পর্যন্ত চালাতে হবে এই ভেবে।যাক এবার আবার করে ক্লাস নাইনে পরীক্ষা দিলাম, কিন্ত মনে এত সংশয় আর ভয় আমি রেজাল্টের দিন স্কুলে না গিয়ে স্কুলের বাইরে একটা গাছতলায় শুয়ে আছি আর আমার এক বন্ধুকে পাঠালাম তু্ই যা গিয়ে আমার রেজাল্টটা নিয়ে আয়। আমার অঙ্কের স্যার জানে আমি হোটেলে কাজ করি তাঁকে গিয়ে বললে উনি ক্লাস টিচার থেকে রেজাল্টটা নিয়ে আমার বন্ধুকে দিয়ে দেবে। সে খুব জোরে জোরে চীৎকার করে বলতে থাকে লালন তু্ই খুব ভালো পাশ করেছিস। আমি তো ভাবতেই পারছিলাম না পাশ করবো কিন্ত এত ভালো সেটা শুনে বিশ্বাস হচ্ছিলো না নিজের উপর। যাই হোক সে এসে আমায় রেজাল্ট কার্ডটা হাতে দেয় সেটা পেতেই আমি কেঁদে ফেললাম ও কিছু না বুঝে বন্ধুকে সজোরে ধাক্কা মারি দেখি নিচের নম্বরের জায়গায় লাল দাগ। আমি উপরে  আমার নামটাও দেখিনি এতটাই ভেঙে পড়েছিলাম। বন্ধুটি মার খেয়ে কাঁদতে থাকে এতই জোরে মেরেছিলাম। সে কাঁদতে কাঁদতে বলে লালন আমি তোকে ভুল রেজাল্ট কার্ডটা দিয়েছি আসলে যেটা দেখছিস ওটা আমার। মনটা সুখের আনন্দের কান্না আর বন্ধুর ফেল করা দুটো মিলেমিশে এক হয়ে গেলো।মনে ভাবলাম যাও একটা বন্ধু পেলাম সেও ফেল করলো ক্লাস টেনে তো সে আমার সহপাঠী হবে না। এমনিতেই আমার এত ছেঁড়া জীবন যে বন্ধুর জন্য কিছু করবো মানে পড়াবো তাকে তাও উপায় নেই আমার সময়ের অভাব। রাতে যখন তারা ঘুমায় আমি তখন দারোয়ান হয়ে বেশির ভাগ দিন অভূক্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছি। তাকে  নিজের কথা বললে হয় বিশ্বাস করবে না নতুবা গরিব বলে আমার সাথে বন্ধুত্বও রাখবে না।মনের কষ্টে হোটেলে ফিরে গেলাম।
একটা সত্যি কথা বলতে কি বন্ধুবান্ধবদের সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে না চলতে পারলে যেমন কষ্ট আবার এড়িয়ে চলা আরো কষ্ট কেউ তো বুঝবে না যে আমার জীবন বা তাদের জীবন একেবারেই আলাদা। আর বুঝবেই বা কেমন করে উঠতি বয়সে তাদের ক্ষেত্রে সবটাই নতুন যেটা আমার ক্ষেত্রে প্রতিটা পদক্ষেপ একটা সংগ্রাম। পেটে ভাতের আর মাথায় পড়াশুনোর চিন্তা থাকলে কি আনন্দ ফুর্তি আসে ওটা আমার শোভা পায় না।
"জীবনের বাঁধাটা এমনই আসে কারো কারো ক্ষেত্রে সেখান থেকেই সৃষ্টি হয় হতাশার, আর ঠিক এই একই হতাশার পেছনে লুকিয়ে থাকে উজ্জ্বল আশার আলো, জীবন মানে একটা পরীক্ষা"
আসছি পরবর্তী সংখ্যায় লালনের আরো কষ্টের দিন আর বাস্তবিক অনেক সুখের দিন যা লালন এখনো নিজেই বিশ্বাস করতে পারে না ।

                                   

Comments

sadamata101.blogspot.com

B-47#বিশ্বকর্মা_পূজো

সন্তোষ ঢাকি

B-71#GANESH_PRASADAM. ( গনেশজির ভোগ নিবেদন মোদক ও পূরণ পুলি)