B-150# রুটি কলা থেকে বেড়ে ওঠা লালন- প্রথম ভাগ


প্রতিবন্ধকতা কখনোই প্রতিবন্ধী নয়, সেটা মনের, জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয়(রুটি কলা থেকে বেড়ে ওঠা লালন) এমন এক বাস্তব কাহিনী। বাংলাদেশের ছেলে লালন  যেখানে কপাল, ভাগ্য,সবটাই প্রতিকূল হলেও জীবন ভেসে গেছে একটাই ইচ্ছে নিয়ে শৈশব থেকে মধ্যবয়সে  চাওয়া খাওয়া নয়পড়বোজগৎটা কে জানবোকেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে “।

এতটুকুও কাল্পনিক নয় এক বাস্তব সংগ্রামের কাহিনী লালনের ।


আমার নাম শেখ লালন, জন্মসূত্রে আমার বাসস্থান বাংলাদেশের চুওয়াডাঙ্গায়আমার মা বাবার সহযোগিতায় আমি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়াশুনা করতে পেরেছিপ্রাইমারি স্কুলে ছিলাম প্রথম থেকেই ফার্স্ট বয়, জীবনের স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবোআমরা তিনজন ভাইবোন বড় দিদি দাদা আমি সর্ব কনিষ্ঠপরিবারের এতোই অভাব অনটন ছিল যে আমার পড়াশুনো বন্ধ করে আমায় স্থানীয় একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করতে হয়, বাবা পেশায় ছিলেন কৃষকবাবাই আমায় হোটেলে কাজে দিয়ে এসেছিলো, আমার খুবই কষ্ট লাগতো কারণ হোটেলের সামনে দিয়ে বন্ধুবান্ধব স্কুলে যেত আর আমি ভাবতাম আমিও তো চেয়েছিলাম তাদের মত স্বাভাবিক জীবন পেতে, কাজে মন বসতো নাবাবার সাথে আমার মনোমালিন্য হয় কেন আমাকে পড়াবে না, একটা সময় আমার কথার কোনো উত্তর দিতেন না,তাতে মা বাবার উপর রাগ অভিমান হতো খুবআমার কষ্ট বন্ধুবান্ধবকে দেখে এতই হতো যে হোটেলের চাকরিটা ছেড়ে দিলাম ভাবলাম আর অন্তত বন্ধুদের সাথে আমার দেখা হবে না, তাই একটু দূরে একটা মুদি খানায় কাজ নিলাম শর্ত একটাই সপ্তাহে দুদিন ছুটি দিতে হবে, তাই প্রচুর পরিশ্রম করতাম অন্তত পক্ষে মালিকের মন আমার প্রতি যেন সদয় হয়, আমাকে স্কুল যাওয়ার অনুমতি দেন


  কিন্তু কি আর করার ভাগ্যের পরিহাস উনি একদিন ছুটি মঞ্জুর করলেন, আমায় বললেন এভাবে স্কুল যাবো বলে কি কাজ হয় গরিবের পড়াশুনা করতে নেয়, “আগে পেট তারপর স্কুলের গেট”। কথাটা খুবই খারাপ লাগলো যার জন্য আমার এই কাজে আসা সেটাই যদি উনি এভাবে বলেন তাহলে তো আমার কাজ করা সম্ভব নয়, দিলাম কাজটা ছেড়েদাদাকে হাতে পায়ে ধরে ভর্তি হলাম ক্লাস সিক্স মনে কি আনন্দ যাক একটু পড়ালেখা করতে পারবোকিন্ত সে আনন্দ বেশিক্ষণ থাকলো না বাবার রাগ আর ঝগড়ায় স্কুলে সপ্তাহে দুদিন যেতে পারলামআবারও গিয়ে সেই একই হোটেলে কাজ নিলাম বাবার চাপে


ক্লাসে বন্ধুবান্ধরা আমার সাথে বিশেষ কথা বলতো না,অথচ এই বন্ধুরাই নিচু ক্লাসে আমার সাথে অত্যন্ত ভাব রাখতো যেহেতু ভালো ছেলে, এখন আর রাখে না একটু তাচ্ছিল্য ভাব দেখাতো এমনকি কথাও বলতো নানতুন ক্লাসের শিক্ষককে বিশেষ একটা চিনতাম না কারণ একটাই শিক্ষক তো চিনতেন না আমায় যেহেতু আমি ক্লাসে আসতাম নাযে কদিন স্কুলে যেতাম শিক্ষক খুঁজে খুঁজে আমায় পড়া জিজ্ঞাসা করতেন আমি পারতাম না তাই আমায় বেঞ্চের উপর কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখতেনকেন পড়া করিনি সেটা কোনো দিনই বলতে পারতাম না আমি ছিলাম অন্তরমুখীআর আমার নিজের কথা বলে কি হবে,কে বা শুনবে আমার হোটেলের কাহিনীআমি শাস্তি পেলে দেখতাম বন্ধুরা খুব হাসতো এতে মনের সাথে দ্বন্দ্ব আর বাড়িতে গেলে মা বাবার সাথে ঝামেলা লেগেই থাকতোহোটেলে কাজের সময় ছিল সকাল সাতটা থেকে প্রায় রাত এগারোটা মাঝে আধ ঘন্টার বিরতি সময়টা স্কুলের পাঠ নিয়ে বসতাম যতটা হয় নিজে নিজেক্লাসে গেলে মনে হতো পড়ালেখা করবো না, বাবা মা ঠিক,আবার বাইরে আসলে মন বলতো ওটাই করবো যেটা আমার মন বলছে -লেখাপড়া কিন্ত ক্লাস সিক্স যেটা অসুবিধে এসে দাঁড়ালো সেটা হোলো আমার উপস্থিতির হারের শতাংশস্যারেরা বলেন এত কম উপস্থিতি পরীক্ষায় বসতে পারবে না, হেডমাস্টারের হাতে পায়ে ধরে কোনোরকমে অনুমতি পাই ক্লাস সিক্স পাশ করি কোনোভাবেধনী লোকেদের এই সব সমস্যা থাকে না আবার গরিবের বাড়িতে একটাই সান্তনা -দেখ লালন পড়াশুনা করে কি হবে?হাতের কাজ শেখ,দেখবি সংসার চলবে,তু্ই ভালো থাকবি,বড় হয়ে তো সেই রোজগারই করতে হবে তার থেকে ভালো রোজগার কর প্রয়োজনে পরে পড়াশুনা করিসকত লোকই তো অনেক বয়সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পড়াশুনা করে তু্ই তাই করমন সায় দেয় না তাদের কথামন একটাই বলে এমনকি কোনো লোক নেই যে একটু আমায় পড়তে সাহায্য করবে সে না হয় হোটেলে কাজ করবো আর এই চব্বিশটা ঘন্টার মধ্যে অন্তত আমাকে সাতটা ঘন্টা দেবে আমাকে আমার মত পড়াশুনো নিয়ে থাকতেখুব রাগ হতো নিজের কাছে, নিজের বিবেকের কাছে কেমন পৃথিবীক্লাস সেভেনে উঠতেই আমি শিক্ষকদের কাছে রীতিমতো মার্ক হয়ে গেলাম


একদিন হেডমাস্টার আমাকে ডেকে প্রায় বন্ড সাইনের মত আমায় লিখিয়ে নেন আমি যদি এই স্কুলে পড়াশুনা চালাতে চাই তাহলে প্রত্যেকদিন উপস্থিত থাকতে হবে” । স্যারেরা যে ভুল ছিলেন তাও বলবো না আমাদের বাংলাদেশে প্রত্যেকটা সরকারী স্কুলে একটা নিয়ম আছে অন্তত পক্ষে প্রত্যেকটা ছেলেকে আশি শতাংশ উপস্থিত থাকতে হবেউনারাই বা কি করতে পারেন নিয়মের বাইরে গিয়ে আমার কর্ম আমার ফল এতটাই বুঝিউনারা ভাবেন আমি ফাঁকিবাজ কিন্ত আমার যে অদম্য ইচ্ছে লেখাপড়া করা কাকে বলি সে কথাহঠাৎ একদিন স্কুলে গিয়ে ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়েছি, কারণ সেদিন শারীরিক পরিশ্রমও নে আর মাথার উপর পাখা চলে, সারা সপ্তাহের ক্লান্তি কি করে জানি ক্লাসে প্রকাশ পেতপ্রশ্ন করলে না পারলে লজ্জা পেতাম এমনকি কোনো কোনো দিন চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসতো নিজের প্রতি ক্ষোভেক্লাস সেভেনে প্রথম পরীক্ষায় আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি তাই তার আগে টানা তিন মাস স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠেনিযাক কোনোভাবে অনেক অনুনয় বিনয় করি স্যারেদের   অনুমতি পাই পরীক্ষারএতদিন আমার সর্বমোট তিনটা বই কিনতে পেরেছি হোটেলের মাইনা থেকে, হাতে টাকা পয়সাও নেই যে পরের বই কিনিতিনটে মাস হোটেলে কাজ করতে পারিনি তাই মাইনাও পাইনিআগামী মাসে যে মাইনা টা পাবো সেটা বাবার হাতে তুলে দিতে হবে এমনিতেই বাবার ধার হয়ে গেছে এই নব্বই দিনে বাজারে তাই পুরো টাকাটাই উনার হাতে তুলে দিতে হবে টাকা তো পাই ছশো টাকাসেখান থেকে বাবাকে কি ভাবে বলি বই কিনতে হবে, শুনলেই তো উনি রেগে যাবেনবই কেনা না হওয়াতে আমি স্কুল যাওয়া বন্ধ করি যাক আর কাউকে তোষামোদ করতে হবে না, আর আমায় লজ্জা পেতে হবে না সকলের কাছেএকদিন সিদ্ধান্ত নেই এই গ্রামের স্কুল ছেড়ে একটু ডিস্ট্রিক্ট লেবেল স্কুলে যাইতাই আমি চুওয়াডাঙ্গা ছেড়ে শহরে চলে আসি সেখানেই একটা হোটেলে দারোয়ানের কাজ নিলামমনে মনে বললাম সারারাত দারোয়ানির কাজ করলে সকালে আমি নিশ্চয় স্কুলে যেতে পারবো এই এত টুকু আশা নিয়ে বাড়ি ছাড়লামচাকরি তো হোলো পেটের সংস্থান করলাম কিন্তু পাঠের সংস্থান কি করে হবেআমার তো একটা স্থানীয় পরিচিতি দরকার যার হাত ধরে স্কুলে ভর্তি হবোহোটেলের পাশে একটা ভাইয়ার সাথে বেশ কয়েক দিন আলাপ জমায় উদ্দেশ্য উনি পরিচয় করিয়ে দিলে আমার স্কুলে ভর্তি অনায়াসে হবেঅনেক ঘোরাঘুরি করে অবশেষে একটা স্কুল পেলাম চুওয়াডাঙ্গা আদর্শ হাই স্কুল


সেখানে ভর্তি হলাম ক্লাস এইটেযাকে ধরেছিলাম উনি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতার একজন নিকটতম ব্যক্তিআমার স্কুলের সময় ছিল সকাল সাতটা থেকে আর দারোওয়ানির কাজ ছিল রাতের আটটা থেকে পরের দিন সকাল আটটা সারা রাত জেগে থাকতে হতো এই কাজে রাতে প্রায় সারারাত লোকে আসতো হোটেলে তাই আমাকেও তটস্থ থাকতে হতো পুরাটা সময়ে কিছু এনে দিলে যাঁরা গেস্ট আসতেন তাঁরা বকশিস দিতেন লোভে গেস্ট আসলে মালিকের থেকে আমার বেশি আনন্দ হতো যদি তাদের মন জয় করতে পারি খেটেকিন্তু মনে একটা আনন্দ ছিল সেটা কাউকে বলতে পারতাম কখনো যে সকাল হলেই স্কুলে যেতে পারবো প্রত্যেকটা দিন যদিও এক ঘন্টা পর ওটাতে অসুবিধে হবে না স্যারদের একটু মানিয়ে নেবো এতকাল তো যেতেই পারতাম না স্কুলে তার থেকে তো ভালোএখানে মাইনে পেতাম আট শত টাকা, এক বেলা খাওয়া আর থাকার পয়সা লাগতো না।কাজের থেকে ছুটি হতে হতে প্রায় সাড়ে সাতটা, তাই প্রায়ই আমার প্রথম ক্লাস হতো না, ক্লাস টিচারের সাথে আমার কখনই দেখা সাক্ষাৎ হতো না বললেই চলে। কোনো ভাবে ক্লাস এইটা টা পাশ করলাম ইতিমধ্যে আমার বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব হয়। আমার ছেলেবেলা থেকেই খেলার প্রবণতা ছিল ভালোই খেলতাম, যখন খেলাধুলা হতো আমায় ডেকে নিয়ে যেত ঐ পর্যন্তই। তাদের সাথে একটু গল্প করা, প্রাণ খুলে আড্ডা দেওয়া হতো না। শহরের বন্ধুরা কেমন যেন মিশতো কিন্তু কোথাও একটা সম্পর্কের ফাঁক ছিল যেটা গ্রামে কখনোই পাই নি।অনেক মা বাবা তাদের ছেলেদের বলতো ঐ ছেলের সাথে বেশি মেলামেশা করিস না হোটেলে কাজ করে কিসের বন্ধুত্ব, কথাটাতে বেশ মানে লাগতো। তাই কোনোদিন আমি তাদের বাসাই  যাই নি যদিও তারা বলতো, আমি বলতাম দেখ তোর আম্মা পছন্দ করে না, একে তো আমি হোটেলে কাজ করি আমি গেলে তু্ই বকাঝকা খাবি বাড়িতে।পরবর্তীকালে এড়িয়ে চলতাম তাদের পাছে যদি দাওয়াত দেয় আমায় ।বন্ধুরা হোটেলে প্রায়ই চলে আসতো আমাকে ডাকতে খেলতে যাওয়ার জন্য তাদেরই বা কি দোষ।


এতে একদিন মালিক আমায় ডেকে কাজ টা দিল ছাড়িয়ে। ঐ অল্প বয়সে কে কার পাশে এসে দাঁড়াবে যথারীতি বন্ধুরাও আমার থেকে দূরে চলে গেলো।ইতিমধ্যে চাকরি নেই কিন্তু ক্লাস নাইনে উঠেছি কি ভাবে ভর্তি হবো। বহু চেষ্টায় একটা চায়ের দোকানে কাজ নিলাম। বাড়ির সাথে কোনো যোগাযোগ নেই বহু আগেই তারাও খোঁজ নেই না, আমিও যাই না কোথায় আছি কেমন আছি জানাতে। একটাই কারণ মা বাবার উপর রাগ নয়,অভিমান কেন আমাকে পড়ায় নি চেষ্টা করলে তো তারা পারতো। প্রয়োজনে বাবা আরো খাটতো, দাদাকে বলতো কাজ করতে এটাই ছিল অভিমান আমি তো লেখাপড়া করতে চেয়েছিলাম।

অদম্য ইচ্ছে একটা মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে লালন তার একটা আদর্শ উপমা আসছি পরের সংখ্যায় জীবন সংগ্রাম ও আর লালনের জীবনের লড়াই করার সাহস নিয়ে.........

"দারিদ্রতা লজ্জার নয়, অদম্য বেড়ে ওঠার স্বপ্নই হোলো দারিদ্রতার অহংকার"

 

Comments

sadamata101.blogspot.com

B-47#বিশ্বকর্মা_পূজো

সন্তোষ ঢাকি

B-71#GANESH_PRASADAM. ( গনেশজির ভোগ নিবেদন মোদক ও পূরণ পুলি)