B-147#আমার বায়ুসেনার দিনগুলি (ষষ্ঠ ও শেষ গল্প)
আমার বায়ুসেনার দিনগুলি (ষষ্ঠ
ও শেষ গল্প)
একটা কথা বহু প্রচলিত আছে কেউ যদি মন থেকে কোন অভ্যাস ছাড়তে চান , যেমন ধরুন নেশা জাতীয় জিনিস মনে মনে ইচ্ছে প্রকাশ করে তাহলে তাকে একুশটা দিন সংযম করতে হয়। একথা কেন বলা হয় তা আমার অজানা, কিন্তু কিছুটা হলেও নিজে মানি।আসলে মনই সব, সেখানে যাঁর যত আধিপত্য,তাঁর তত মনের উপর সংযম, তা থেকেই হয়তো সংকল্প দৃঢ় হয়।আমি তো একুশ দিনের বেশি এই বায়ুসেনাতে কাটিয়ে ফেলেছি তাও কেন থাকার ইচ্ছে নেই, হয়তো সে প্রশ্ন মনকে কখনো করিনি তাই হয়তো নেতিবাচক আবদ্ধে জড়িয়ে এখনো। যে সময় বাড়ি ছেড়েছিলাম দৃঢ় সংকল্প একটা ছিল জীবনে কিছু করতে হবে, আসার পরে বুঝেছিলাম বাস্তবটা আমার চিন্তাধারার থেকে কয়েকগুন বেশি, একেবারেই বিপরীতমুখী, আমার নিজের জন্য । থাক সে সব কথা সপ্তাহ শেষ,পরের সপ্তাহ শেষ, দেখতে দেখতে মাসের শেষ দিনে এসে পৌঁছুলাম। মনে একটা আনন্দ আজকের দিনটা পেরোলেই আগামীকাল মাইনে পাবো।
যেটাই জীবনের প্রথম সেটাই কিন্তু আনন্দের হয় সকলের ক্ষেত্রে। পরের দিন সামান্য কিছু দৌড়ের চাপ কারণ মাইনে আনতে যাবো, শুনেছি অনেক কাগজে পত্রে সই করতে হবে,সময় লাগবে প্রায় সেখানে অর্ধেক বেলা চলে যাবে। পরের বার থেকে সে দেরি আর হবে না।রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম পরের দিন স্টাডি রুমে গিয়ে দেখি সেদিনও কোনো পড়াশুনো নেই, কিছুক্ষন পরে ওয়ারেন্ট অফিসার মুখার্জী এলেন ও এমন কিছু কথা বললেন যেটা মনে ধরে গেলো, একটা দাগ কেটে দিল, সে দাগ মোছার নয়, এতটাই গভীরে স্থান পেলো। উনি বললেন”আজ তোমরা জীবনের প্রথম মাইনে পাবে পাকাপাকি সরকারী ভাবে, এর আগেও হয়তো তোমাদের মধ্যে কেউ টিউশন করে, বা নানান ভাবে অর্থ উপার্জন করেছো, তার থেকে কিছুটা নিজের বিলাসিতায় খরচ আবার কিছুটা ভাই বোনের জন্য খরচ করেছো। একটা খুব জোরের সাথে বলতে পারি কেউ কি নিজের উপার্জনের অর্থ কখনো মা বাবার হাতে তুলে দিয়েছো দু একজন ছাড়া? কারণ একটাই তোমরা ভাবতে বাবা চাকরি করেন, কেনই বা দেবো, আর ধরেই নিয়েছো যে মা বাবা তোমার অর্থের তোয়াক্কা করেন না। আমার তো এই সামান্য রোজগার কি হবে তা দিয়ে”। কথাটা বলতে বলতে একটু অন্য মনস্ক হয়ে ওয়ারেন্ট অফিসার মুখার্জী বেশ কিছু ফর্ম একটা লম্বাটে ধরনের ব্যাগ থেকে বার করলেন, একটু দূরে বসেছিলাম দূর থেকে দেখে যেটা বুঝলাম পোস্ট অফিস সংক্রান্ত কিছু নথি পত্ৰ।
আবারওবললেন হ্যাঁ যেটা বলছিলাম”আশা করেন মা বাবা অনেক বেশি তোমরা উল্টোটা ভাবো, বয়সটা অল্প তাই মুল্যবোধ হয়তো কাজ করেনা বা করেনি এতকাল। জানো কি হয় না দিতে দিতে সেটা তোমাদের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়, আর মা বাবারাও তোমাদের ছাড়তে শুরু করে কোনো কিছুই আশা না করে, মাঝে শুধু তৈরী হয় একটা মন খারাপ করার বিচ্ছেদের দেওয়াল সেটা তোমরা বুঝতে পারো না,মা বাবার কাছে সেটা ক্ষত হয়ে রয়ে যায়। আচ্ছা একটা উদাহরণ দেই কখনো কোনো অনুষ্ঠানে মা বাবাকে কিছু না কিছু নিশ্চয় দিয়েছো, কোনোদিন খেয়াল করেছো বা দেখেছো তাঁদের মুখের চাপা হাসির ছাপ, আনন্দের, উত্তেজনার মনের জোয়ার প্রকাশ পেতে সেটা নিশ্চয় বুঝেছো মা যখন তোমায় জড়িয়ে বলেছে খোকা আমার জন্য কেন কিনলি?
দেখতে দেখতে আটমাস কেটে গেলো, অনেকটাই নিজেকে ধাতস্থ করে ফেলেছি, কিন্তু মন পরে থাকে বাড়ির জন্য চিঠি অনবরত আসে দিদির, মার,বাবার। আমার address টা দুই লাইনের সেটাও প্রথম প্রথম আমায় ভাবাতো AC/UT SEN D P, 56 APO, আরো একটা কি লেখা থাকতো সেটা এখন মনে নেই, ব্যস তাতেই চিঠি চলে আসতো সুদূর কলকাতা থেকে মাদ্রাজে মাত্র দুই তিনদিনের মধ্যেই। হয়তো এয়ারফোর্স বলে বিশেষ সুবিধে ছিল। APO কথাটা মনে আছে ARMY POST OFFICE ।
দিন যায় বাড়ির প্রতি টান বাড়তে থাকে, শুনেছি দেড় বছরের আগে আমরা কেউই ওয়ারেন্ট পাবো না এখনো প্রায় সাত মাস বাকি। আর নয়,মন স্থির করেই ফেলি হয় দিন কয়েককের ছুটি না হয় সবটাই মাটি। কর্তৃপক্ষ কে জানাতেই কোনো ভাবে পাশ হোলো না সে আর্জি।একদিন মনের সে কথা জানালাম সার্জেন্ট মুখার্জীকে উনি সমস্ত কথা শুনলেন,আমায় আলাদা করে নিয়ে গিয়ে অন্য ঘরে বসালেন।একটা কথা শেষমেশ বললেন জানো এখানে চাকরি পাওয়া অত্যন্ত সহজ কিন্ত বের হওয়াটা অনেকটাই কঠিন।
বহু অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একটা সময় সম্মতি জানালাম চলে যাওয়ার অর্থাৎ বিদায়ের মন কিছুতেই মানছিল না। একটা সময় মনে হোলো অনেকটা দিন নষ্ট হয়ে গেলো জীবনের আবার করে নতুন ভাবে শুরু করতে হবে সবকিছু। প্রথমেই পড়াশুনা আবারও দিব্যানন্দ মহারাজ কে বলতে হবে গ্রাজুয়েশনটা শেষ করে চাকরি খোঁজা, জানি না পাবো কিনা,মনের মধ্যে নানান দ্বন্দ্ব,কিন্তু একটা কথা বিশ্বাস ছিল নিজের উপর কিছু না কিছু তো করবোই। মোটের উপর প্রায় বারোখানা ইন্টারভিউয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। শেষ ইন্টারভিউ ছিল এয়ার কমোডার নাদকার্নির কাছে।
শুনেছি রাশভারী লোক, কিন্তু কি এসে যায় সংকল্প যেখানে স্থির সেখানে টলাতে পারবে না আমায় কোনোমতে।একটা মিথ্যে কথার আশ্রয় নিতে হয়েছিল সেদিন “মায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে”, আমি একমাত্র ছেলে, তাই প্রমান স্বরূপ যথোপযুক্ত ডাক্তারির কাগজ আনিয়েছিলাম বাড়ির থেকে।কর্তৃপক্ষ আমায় রিলিজ করলেন ও আসার ওয়ারেন্ট ও হাতে ধরিয়ে দিলেন।মনে ভাবলাম “আমার আর রাখাল সাজা হোলো না” যে স্বপ্ন মনে একটুকু হলেও বাসা বেঁধেছিলো,তা স্বেচ্ছায় বিদায় দিলাম।
আসার সময় আমার পাওয়া সমস্ত কিছুই দিয়ে এসেছিলাম বন্ধু নিক্সনকে, শুধু সঙ্গে এনেছিলাম সেই স্টিলের থালা ও মগ। মেইন গেট থেকে বেড়িয়েই উফফ কি শান্তি, এক চেনা প্রকৃতির মাঝে নিজেকে পেলাম এক নতুন ভাবে, মনে হয়েছিল এতকাল বন্দী দশা কাটিয়েছি, তাই আজ আমি মুক্ত। চেন্নাই স্টেশনে আসার আগে নেমে পড়লাম এগমোর স্টেশনে একটা ওয়াকমান কিনলাম সঙ্গে বেশ কিছু ক্যাসেট, প্রথমেই সিলসিলা ও মেরা নাম জোকারের ক্যাসেট কিনে ট্রেনে চেপে বসলাম সেই একই ট্রেন মাদ্রাজ মেল।ট্রেন ছাড়তেই আশেপাশের লোকজন কে বিশেষ পছন্দ হচ্ছিলো না কারণ একটাই একটা সিস্টেম বহুকাল ছাড়া হয়ে গেছে অর্থাৎ সিভিল লাইফ। এই লাইফে প্রাণ আছে কিন্তু অধিকাংশই মানুষজন লাগাম ছাড়া উদ্দেশ্য বিহীন ভাবে ঘুরে, কথা বলে সময় কাটান সেটা মানতে অনেকদিন লেগেছিলো প্রায় মাস তিনেক তো হবেই। নিজেকে বুঝেছিলাম আমার হাঁটা চলা, পরিমিত কথা বলা, নিজের সাথে নিজেকে অন্যের সাথে আলাদা করে রাখা একটা স্বভাবে পরিণত হয়েছিল। আসার পর মা, বাবা দিদি কারোর সাথে বিশেষ একটা কথা বলতাম না প্রয়োজন ছাড়া। কলেজে যেতেই মহারাজ বলেছিলেন “জানি তু্ই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিস, যাওয়ার আগেই তোকে বলেছিলাম ও জীবন দেবপ্রিয় তোর নয়”। উনি দেখেই কিভাবে বলেছিলেন যে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি তা আমার কাছে আজও অজানা।
Comments
Post a Comment
always