B-155# রুটি কলা থেকে বেড়ে ওঠা লালন- ষষ্ঠ ও শেষ ভাগ




একটা মানুষ হয়তো ভুল বসত একই আবর্তে ঘুরতে থাকে যেটা হয়তো আমি নিজেও করে চলেছি এতকাল। যা আমার হওয়ার নয় সেখানেই প্রতি পদক্ষেপে বাধা,আর তাতেই আমরা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাই, প্রশ্ন একটাই শুধুই আমার ক্ষেত্রেই কেন? আল্লাহ হয়তো অন্য আরো ভালো কিছু রেখেছেন আমার জন্য সেটা অনেক পরে বুঝি ।অবশ্য এটার ও প্রয়োজন আছে মানুষ ভুল থেকেই তো শিক্ষা নেয়।কোনো কিছু জোর করে করলে সেটা হয়তো পাড় পাওয়া যায়, কিন্তু মাসুলটাও গুনতে হয় অনেক বেশি পরবর্তী সময়ে।
হোটেলের কাজ, আমড়া বিক্রি, ফলের ব্যবসা, আবারও হোটেলের কাজে একই আবর্তে ঘুরে চলেছি সেই ছোটোবেলা থেকে । জীবনের উদ্দেশ্য তো একটাই সব কিছুই করতে পারি আমি ঐ পড়াশুনোটা যদি চালিয়ে নিয়ে যেতে পারি। একদিন রাতে ভাবতে ভাবতে সারাটা রাত জেগে রইলাম,উত্তর পেলাম লেখাপড়া- ঐ পথে যদি যাই আমার আর কোনো বাধা আসবে না।এতকাল যে সব করেছি সেগুলো ছিল অভিজ্ঞতা এটারও প্রয়োজন আছে,তা না হলে নিজেকে শানিত করবো কি ভাবে- কোনটা ঠিক কোনটা ভুল?
পরীক্ষার খাতা হাতে পেয়ে আমি তো খুশি তখন প্রিন্সিপাল স্যারকে আমার সংগ্রামের সব কাহিনী বলি। উনি কিছুটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন আর আমায় বলেন তুমি স্কুলে যত টাকা পয়সা খরচ করেছো তোমাকে সেগুলো বৃত্তি হিসেবে দেখিয়ে ফেরৎ দেওয়া হবে।মনে মনে খুবই আনন্দ পেলাম এই কটা টাকা আমার কাছে স্বপ্নের মত মনে হয়েছে। উঠলাম বারো ক্লাসে কিন্ত ঐ স্যার যাঁকে প্রিন্সিপাল স্যার ডেকে পাঠিয়েছিলেন উনি তো একদিন আমায় ক্লাসে পেয়ে যথেচ্ছ অপমান করলেন সবার সামনে।
একদিন যায়, দুদিন যায়, আমাকে ক্লাসে দেখলেই উনার খুব রাগ হয়,উনার সব প্রতিশোধ বা পুরোনো রাগ উগলে দেন আমরা উপর। একদিন একটু রুখে দাঁড়ালাম, বললাম স্যার আপনি তো আমার মাস্টার আমাদের শিক্ষা দেন, আপনি বিশ্বাস করুন আপনার সম্বন্ধে কোনো নালিশ জানানোর জন্য বা উদ্দেশে আমি প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে যাই নি। আমার বিশ্বাস ছিল আমি সর্বোচ্চ নম্বর পাবোই পাবো, সেখানে আমাকে পরীক্ষায় অনুপস্থিত দেখানো হয়েছে, সেখানেই আমার আপত্তি। আসল সত্যি টা কি সেটা তো জানতেই হবে।উনি তাও আমায় কি জানি কি সমানে বলেই চলেছেন, না পেরে বলেই বসলাম, স্যার আপনি ক্লাসের যে কোনো ছাত্রের সাথে আমার পড়াশুনা সংক্রান্ত বা জীবন সম্বন্ধে অভিজ্ঞতার কথা নিয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারেন তাতেই আমার সত্যতা আমি প্রমান করে দিতে পারি।
এই শুনে স্যার এতই রেগে গেলেন আমায় ক্লাস থেকে বারই করে দিলেন। জীবনে কোনোদিন আমি আমার সহপাঠীদের আমার কথা জানাই নি কারণ একটাই তারা তাহলে আমাকে অনেক ছোটো ভাববে, হয়তো মেলামেশাও করবে না। 
বারো ক্লাসের পরীক্ষায় আমারই এক সহপাঠী সে হিসাবটা বিশেষ পারতো না,আমাকে অনুরোধ করে অঙ্ক গুলো দেখাতে। আমি তাকে অঙ্ক দেখাতে গিয়ে ধরা পড়ি ও আমায় শিক্ষক ক্লাস থেকে বার করে দেন। পরীক্ষায় পাশ করলাম তবে নূন্যতম নম্বর নিয়ে।এটা ছিল আমার ভুল কাজ। তবে মনে খুব আনন্দ পেলাম নিজের চেষ্টায় লড়াই করতে করতে 2009 সালে দুই খানা ডিগ্রি তো পেরিয়ে গেলাম, নিজেকে শিক্ষিত ভাবতে বেশ গর্ববোধ হচ্ছিলো।
নিজের জীবনের অতীত ইতিহাসে আর ফেরার ইচ্ছে নেই সেই ধরণের কাজ আমার আর করতে ইচ্ছে করে না। যা করবো সবই পড়াশুনা নিয়ে ।প্রথম শুরু করি পথ শিশুদের নিয়ে পড়াশুনা,পঞ্চাশ টাকার বিস্কুট কিনে ওদের খাওয়ানো সেখান থেকেই অবৈতনিক স্কুল শুরু। যেহেতু আমি নিজেও এই পথের কষ্টটা বেশিরভাগ টা বুঝি।ঢাকার ফার্মগেট, আনোয়ারা পার্ক এই স্থানের বাচ্চাদের দিয়ে শুরু করি জীবন, বুঝেছি এদের শিক্ষিত করতে পারলে মনের যে আনন্দ পাবো সেটা আমার সারাজীবনের কষ্টের ফসল হবে একদিন।তাদের খাবারের লোভ দেখিয়ে পড়াতাম, এটা বুঝেছিলাম ছোটবেলায়,কেউ যদি আমায় ডেকে খাওয়াতো তখন ঐ শিশু কালে ভাবতাম এর থেকে আপনজন আমার এ জীবনে আর কেউই হতে পারে না।

শিশুকালে ক্ষুধার কষ্ট একটা শিশুই বুঝতে পারে, তখন তার কাছে জামাকাপড় নিতান্তই একটা তুচ্ছ বিষয়। একজন অর্থবান লোকের প্রতিনিয়ত নতুনত্ব পোশাক অনেকটাই অন্যকে জ্বালানো, আর এক জন শিশুর ক্ষুধা নিবারণ তার চিত্তের পরম তৃপ্তির চরমতম সন্তুষ্টিকরণ।অতিরিক্ত বিষয়ে বিষ হয়, আশয়ে বাড়ে আশ -আশা এটাই বাস্তব।একজন সফল ও অন্যের থেকে ব্যতিক্রমী মানুষ হতে হলে নিজেকে কষ্টের মধ্যেও ব্যতিক্রমী হতে হয়, নিজেকে দহন করতে হয়, যাঁরা নিজেকে দহন করতে পিছপা থাকেন তাঁরাই সাধারণ মানুষ হয়ে রয়ে যান আজীবন।

কলা রুটি আমার দীর্ঘ বারো বছর সংগ্রাম জীবনের সাথে এমন ভাবে জড়িয়ে, আজও সেই অভ্যাস যায় নি, যেখানেই যাই আমি ওদের ব্যাগে নিয়ে চলি ক্ষিদে পেলেই হোলো।
অনেক জায়গাতে হয়তো এটা বলা হয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত যাঁরা তাঁরা বরাবরই বঞ্চিত থাকে,আর যাঁরা সুবিধা গুলো ভোগ করে তারাই সুবিধাগুলো বেশি পায় ।আমরা কোথাও গেলে যখন আমরা অসহায় তখন আমার কথা কেউ শোনে না,আর যাঁর টাকা পয়সা আছে তাঁদের সুপারিশের ও অভাব থাকে না।আমার স্কুলে একটাই ভর্তি হওয়ার শর্ত ছিল যাঁরা মাদকের সাথে যুক্ত তাঁদের কে নেওয়া হবে না।
 কারণ ঢাকার তেজকোনি পাড়ায় যখন থাকতাম একটাই অশান্তি প্রায় অধিকাংশ  বাড়িতে বাড়িতে, রাত হলেই মাদক দ্রব্য খেয়ে পুরুষেরা বাড়ির মহিলাদের উপর চড়াও হতো আর অশান্তি হতো। অথচ এই মাদক দ্রব্য যারা রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করছে পুলিশ তাদের কে ধরে না, যত অত্যাচার যারা কিনছেন তাদের উপর। ভাবতাম এ কেমন প্রশাসন ব্যবস্থা পুলিশ তো সবই জানে। পুঁজিপতি, ক্ষমতাবান, গুন্ডা তাদের অগণিত অর্থ, এই ক্ষমতার জেরে তাঁরা পাড় পেয়ে যান। গরিব মানুষের উপর যত অত্যাচার, তাদের রোজগারের সামান্য পুঁজি আর সেখানেই তাকে বাধ্য করা হয় কোনোভাবে সেই পথে ঠেলে দিতে, শোষণ ও নির্যাতিত নীতির একমাত্র তারাই স্বীকার হন।
ইতিমধ্যেই ঢাকায় ফার্মগেট তেজকুনি পাড়ায় একটা নাম ডাক হয়েছে লালন স্যার বলে, আমার প্রায় আনুমানিক সত্তর -আশি টা ছাত্র সেই এলাকায় হয়ে গেছে। লালন স্যারের কাছে পড়তে গেলে কোনো পয়সা লাগে না, এমনকি যাঁরা অর্থবান তারাও এসে পড়ে যেত আমার কাছে বিনা পয়সায় ।কিছুদিনের মধ্যে  ধরা পড়লাম রাজনৈতিক নেতাদের খপ্পরে কারণ যেহেতু আমি পড়াশুনোর সাথে সাথে মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতাম, শিশুদের বোঝাতাম তারাই পারবে নিজের মা বাবার সাথে সংগ্রামের পথে যুঝতে।
 এতে মাদক বিক্রয়কারীদের হয়তো কিছুটা হলেও ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছিলো।আর আমার শত্রুর সংখ্যা বেড়ে গেলো,অসামাজিক লোকজন, রাজনৈতিক নেতা আমার প্রতি কটু ও বিদ্রুপ মন্তব্য করতে লাগলো, এটা আমার অজানা নয় । হাতিয়ার ছিল ঐ শিশুগুলো যাঁরা বড় হয়ে কোনো না কোনোদিন লালন স্যারকে বুঝতে পারবে। একজন প্রতিবাদী মনই একজন প্রতিবাদী দল গঠন করতে পারে, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, উদ্যেশ্য যদি সৎ হয় আর বিন্দুমাত্র নিজের যদি কোনো স্বার্থ না থাকে ।
পথশিশু ছাড়াও বহু নামীদামি মানুষের ছেলে মেয়েরা আমার ছাত্র ছাত্রী ঢাকা শহরে।আমি অঙ্ক, ইংরাজি ও কমার্স পড়াতাম কোনোদিন কোনো বাচ্চাকে মারধোর করিনি আমার মনে হতো সেটা করলে তাদের না বোঝার উপর অপমান করা হবে,তাতে তারা লজ্জায় আরো গুটিয়ে ফেলবে নিজেদের। আমি সবসময় একটা জিনিস জানতে চাইতাম তাদের phase index of mind আসলে কি চাইছে আমার থেকে। বেশীরভাগটা ফেল করা ছাত্রদের পড়াতাম, এমনিতেই একটা কষ্ট থাকে ফেল করার, বকাবকি করলে সেটা আরো বেড়ে যাবে। আমার ধারণা বেশিরভাগ শিক্ষক বকাবকি করেন তাঁদের নিজস্ব না জানার দুর্বলতার থেকে।
ফ্রি ফ্রি করে পড়াতে পড়াতে এমন হোলো হোস্টেল ভাড়া, মেসের টাকা বকেয়া পরে গেলো। আমার নামডাক আছে, নামে তালপুকুরে ঘটি ডোবে না।
একদিন দেখি ঢাকার জিয়াউদ্দানে একটা শিবির লেগেছে সেখানে মানুষের সেবামূলক কাজ চলছে যেমন রক্তদান, প্রেসার মাপা, সুগার টেস্ট চলছে আমার এক ছাত্রী আমার সাথে থাকে সাহায্য করার জন্য । মনে ভাবলাম পড়াশুনো শেখানোর পাশাপাশি আমি নিজে যদি এই কাজগুলো শিখি তাহলে আরো মানুষের উপকারে আসতে পারি। সেটা শিখে নিজেকে রপ্ত করলাম।
পাশাপাশি পড়াশুনো চালিয়ে গেছি নিজের ডিগ্রি বাড়ানোর জন্য নয় , নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যদি অন্যের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারি।পরবর্তী সময়ে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছি LLB নিয়ে বিষয়টা ছিল Victimology and Restorative Justice নিয়ে। উদ্দেশ্য যাঁরা সমাজে victimise হয়ে চলেছে দিনের পর দিন তাঁদের পাশে দাঁড়ানো।যেহেতু আমি নিজে এতকাল victimise হয়েছি।

আমার যারা ছাত্র ছিল পথ শিশু তাদের নিয়ে শুরু করি আমার পথ চলা। বিগত দীর্ঘ নয় বছর ধরে যা এখনো আরো পুরোমাত্রায় চলছে আর নিজেকেও সমর্পন করেছি ।আমি এক টাকার বিনিময়ে শুরু করি শিক্ষা, ডাক্তারি সেবা,খাদ্য ও বস্ত্রের যোগান এই মুহূর্তে ঢাকা শহরে পাঁচ খানা অফিস, প্রায় হাজার দেড়েক স্বেচ্ছাসেবী লোকজন, বাণিজ্য মেলায় বিগত পাঁচ বছর ধরে প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাত হাজার মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি।আমার সংস্থার নাম "অপুরূপ বাংলাদশ"।
 বাংলাদেশে তিপ্পান্ন টা থানা এখন আমার সহযোগিতায় হাত বাড়িয়েছে। এই মুহূর্তে আমার কাছে সম্পূর্ণ বাংলাদেশের থেকে সাড়ে চার লক্ষ্যের একটা ব্লাড ডোনারের লিস্ট আছে, যেখানে আপনারা যে কেউ বিনামূল্যে চব্বিশ ঘন্টা রক্ত সংগ্রহ করতে পারেন।শর্ত একটাই যাঁর রক্তের প্রয়োজন তিনি কোন হাসপাতালে ভর্তি আছে, একটা বিশদ বিবরণ দিলেই সেটা পাওয়া সম্ভব।আরেকটা জিনিস শুরু করেছি মাত্র এক টাকার বিনিময়ে আইনি সেবা বিশেষত গরিবদের জন্য। বহু মানুষ আছেন ঘটি বাটি বিক্রি করে আইন চালান সুবিচার পাওয়ার আশায়। মানুষ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোক এটাই আমার লক্ষ্য, ঠকতে যেন না হয় জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে।কেউ যদি সামান্য আর্থিক ভাবেও এগিয়ে আসেন যোগাযোগ করতে পারেন নিচের ঠিকানায়। এক সাথে এগিয়ে চলাই হোলো অন্যের হাতটিকে আরো মজবুত করে তোলা, সে মজবুত হলে "অপরূপ বাংলাদেশ " আরো মজবুত হবে, মানুষ সেবা পাবে।
একটাই কথা বলতে পারি উদ্দেশ্য আর পৌঁছনোর জায়গাটা চিন্তা শক্তির অনেক উর্ধে চাইলে সেটা শুধুই সম্ভব বলবো না, একেবারেই সহজ ও সরল, চেষ্টা আর টিকে থাকার সংগ্রামটাই হোলো লক্ষে পৌঁছনোর সিঁড়ি।
"অপুরূপ বাংলাদেশ"
4/A ইন্দিরা রোড,
মেহবুব প্লাজা, ষষ্ঠ তল,
ফার্মগেট,
ঢাকা।

Comments

sadamata101.blogspot.com

B-47#বিশ্বকর্মা_পূজো

সন্তোষ ঢাকি

B-71#GANESH_PRASADAM. ( গনেশজির ভোগ নিবেদন মোদক ও পূরণ পুলি)