B-156#খাপকাটা ক্ষীরপাই

নামটা শুনে আপনারা প্রত্যেকে অবাক হচ্ছেন তাই তো? একটা সময় আমিও অবাক হয়েছিলাম। এটা বাঁকুড়া জেলার একটা প্রত্যন্ত জায়গার নাম আর সেই নামেই একটা রাষ্ট্রয়ত্ত ব্যাংকের নাম তাও আবার স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার একটা শাখা।2009 সাল বাঁকুড়া জেলাটা রীতিমতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছি ব্যবসার খাতিরে। বেশ বড় ধরণের একটা অর্ডার পেয়েছি জোনাল ম্যানেজার মারফৎ কিন্ত সে জায়গায় আমায় সরোজমিনে যেতে হবে একটা তদারকির কাজে।
পশ্চিমবঙ্গে একটা প্রচলিত কথা আছে "মেরে খাপ খুলে দেবো" আদৌ কথাটার মধ্যে কোনো যথার্থতা আছে কিনা আমার জানা নেই। লোকে কেনই বা বলে কে কার খাপ খোলে, খাপের অর্থ কি সেটাও অজানা। আমার এই খাপকাটা ক্ষীরপায়ের কিন্তু মানে খুঁজে পেয়েছিলাম, নিজের কতটা খাপ খুললে ক্ষীর পাওয়া যায় সেটাই বাস্তবিক কাহিনী আজকের গল্পের।
আমাকে আগের থেকেই ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ বলে দিয়েছিলেন বাঁকুড়া মোড়ে যদি সকাল সাতটার মধ্যে পৌঁছনো যায় সেখান থেকেই একটাই বাস ছাড়ে সারাদিনে, আবার সেটা বিকেল পাঁচটায় খাপকাটা ক্ষীরপাই থেকে ফেরৎ আসে , ওটা ধরতে পারলেই গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব।
আমি যথারীতি বাড়ির থেকে রওনা দি রাত প্রায় আড়াইটে নাগাদ ডানলপে পৌঁছনোর জন্য। ধর্মতলা থেকে বাঁকুড়া মুখী প্রথম বাস ছাড়বে রাত তিনটে সেটা ডানলপ হয়ে বাঁকুড়া যাবে। জুন মাস, একে তো প্রচন্ড গরম তার মধ্যে বাঁকুড়া পৌঁছলাম কিন্তু দেরিতে প্রায় নটা বেজে গেছে, যথারীতি বাস ও চলে গেছে পেলাম না। উপায়ন্তর না দেখে সামনের একটা ঝুপড়ির চায়ের দোকানে গেলাম চা খেতে,উদ্দেশ্য একটাই কি ভাবে সেই জায়গায় পৌঁছনো যায়, সমাধানের পথ বার করতে। এমনিতেই ঠিক তারই পাশ দিয়ে চলে গেছে কাঁচা মোরামের রাস্তা। চায়ের দোকানটা অনেকটা জাঙ্কশন বলা চলে,পথ চলতি মানুষ এমনিতেই ওখানে নিশ্চয় চা খেতে এসে একটু জিরিয়ে নেন। এমনকি বরাত ভালো থাকলে ব্যাংকের কর্মচারীর ও দেখা মিলতে পারে সেই জায়গায় এই আশা নিয়ে আমি ও চা খেতে বসলাম। দেখলাম চিঁড়ে ভিজলো না, আমাকে একাই যেতে হবে।কলকাতা ফিরে যাবো না এটা সত্যি ।এসেছি যখন মনে মনে বুঝলাম আজ আমায় প্রচুর ঘাম ঝরাতে হবে, বলতে পারি আজ আমি নিজের খাপ নিজেই খুলবো। ভাবছি দেখা যাক কতটা খাপ খুললে আজ আমি দিনের শেষে কতটা ক্ষীর পাবো। এমন সময় দেখি সামনেই এক রিকশাওয়ালা দেড় ফিটের সিটে বসে পা লম্বা করে টেনে ঘুমোচ্ছে।
ভাবলাম ওকেই গিয়ে বলি ওহে যাবে নাকি খাপকাটা ক্ষীরপাই ব্যাংকে। সে একটু থতোমতো খেয়ে আমার দিকে তাকালো এমন এক ভুরু কুঁচকে আমায় দেখলো তারপর মিচকি হেসে,আবারও শুয়ে পড়লো।আমি ভাবলাম ব্যাটা পাগল,এদিকে সেও যে মনে মনে আমায় পাগল ভেবে বসে আছে সেটা কিছুক্ষন পরে বুঝলাম। চায়ের দোকানে জিজ্ঞাসা করাতে উনি বললেন সে তো মেলা দূর প্রায় ষোলো সতেরো কিলোমিটার হবে, কি ভাবে যাবেন।
কোনোদিন সে পথে কোনো রিকশা করে কেউ গেছেন কিনা আমার জানা নেই। আপনি গেলে আপনিই হয়তো প্রথম হবেন। এবারে বুঝলাম রিকশাওয়ালা কেন হেসেছিলো।আমি বলাতে উনি রিকশাওয়ালাকে ডাকলেন, এসেই সে বললো একশো আশি টাকা লাগবে আসাযাওয়া নিয়ে ছয়খানা গ্রাম পেরিয়ে পৌঁছবেন খাপকাটা ক্ষীরপায়ে। ভাবছি কত বলা যায়,কতটা দাম কমানো যায়।দরাদরি তে একশো ষাট টাকায় রাজি হয় সে।
চায়ের দোকানে পাঁচ টাকা দামের টাইগার বিস্কুট গোটা আটেক কিনে আরো এক কাপ চা খেয়ে উঠে বসলাম রিকশোতে।
লাল মোরামের রাস্তা দিয়ে রিকশো চললো প্যাডেলের ক্যাচক্যাচানি আওয়াজ আর মাঝে মাঝে ফলস খেয়ে যাওয়া প্যাডেলের শব্দে। দুই দিকে ধু ধু করছে মাঠ আর বাঁকুড়ার প্রচন্ড গরমের লু কানের পাশে গরম হওয়ার সুক্ষ আওয়াজে বাঁশির মত বাজছে। হাল্কা গান ধরলাম "এই পথ যদি না শেষ হয়...." মনে হচ্ছিলো রিকশাচালক এই মুহূর্তে উত্তমকুমার আর বসার সিটটাকে শক্ত করে ধরে আমি দেবপ্রিয় সেন নই সুচিত্রা সেন।
একটা গ্রাম পেরোতেই এক বড় বাঁধের সামনে এসে রিকশাওয়ালা বললো বাবু একটু বসুন আমি এখুনি আসছি। এই যাবো আর আসবো। বসে বসে ধুলো খাচ্ছি যখনই কোনো বাইক আসছে। পরনের টি শার্টটা একটু তুলে মাথা ঢেকে নিলাম উপায় নেই। বাবু এলো মিনিট পাঁচেক পর একেবারে কেষ্ট মুখার্জী হয়ে, এসেই বললো বাবু যা গরম পড়েছে তাড়ি না খেলে হতো না,এতটা রাস্তা জুড়ে রিকশা চালানো।
দেখি সত্যি সত্যি রিকশার জোর বেড়ে গেলো আর তার উদ্দাম উৎসাহ আমাকে আরো প্রাণবন্ত করে দিল এই গরমেও।চলেছি একটার পর একটা গ্রাম পেরোচ্ছে আর আমি গুনে চলেছি এক, দুই, তিন করে। রাস্তা কোথাও কোথাও অনেকটা চড়াই আছে তখন আমিও নেমে রিকশা ঠেলছি আর যেই উৎরাই আসছে সে কি আনন্দ, তার আনন্দে আমিও নিজে তারই সাথে সামিল হচ্ছি কিন্তু নাকটাতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিলো একে তো প্রকৃতির গরম হাওয়া, তার উপর তার গায়ের ঘামের বোটকা গন্ধ আর পুরস্কার স্বরূপ তাড়ির বিচ্ছিরি সুবাস আমাকে টলিয়ে দিয়েছিলো।পৌঁছলাম ব্রাঞ্চে প্রায় সাড়ে তিনটে। ব্রাঞ্চ ম্যানেজার মুর্মু সাহেব তো অবাক আমি রিকশাতে করে এসেছি বলে। উনি বললেন আমরা তো ভেবেই নিয়েছি কলকাতার মানুষ এত দূরে কষ্ট করে  কি করে আসবে?আমরাই পারি না। কোনকোনো দিন তো আমরা বাঁকুড়া যাই না ব্রাঞ্চেই থেকে যাই।
মুর্মু সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতে মাঝে মধ্যেই বাইরে গিয়ে দেখে আসি ব্যাটা আছে কিনা। সে গাছতলায় দিব্যি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে,বুঝেছি লোকটি ফাঁকি দেবে না আমায় নিয়েই ফিরবে।
কাজ শেষ করলাম প্রায় সাড়ে চারটে, চললাম বাঁকুড়ার উদ্দেশ্যে -বাঁকুড়া মোড়ে এসে পৌঁছলাম প্রায় রাত্রি পৌনে আটটা হবে।
 এখনো বাঁকুড়া মেইন ব্রাঞ্চ যেতে বাকি আছে, ম্যানেজার বলেছেন উনি থাকবেন দশটা পর্যন্ত। রিকশাওয়ালাকে একশো আশি টাকা না দিয়ে পারলাম না খারাপ লাগছিলো। তবে যাওয়াআসা নিয়ে সাত ঘন্টা রিকশাতে বসে থাকাটা যে কতটা কষ্টের ছিল আজও অনুভব করি।
সারাদিন খাওয়া হয়নি,ঐ টাইগার বিস্কুট চলছে। মেইন ব্রাঞ্চে কাজ করে তবেই খেতে বসবো ভালো হোটেল দেখে। সাড়ে নটার মধ্যে সমস্ত কাজ সেরে এলাম বাঁকুড়ার এক বিখ্যাত জায়গা "পোকা বাঁধ-বাস স্ট্যান্ডে"।
খাওয়াটা ছিল অতীব সুস্বাদু পোস্তর বড়া,  কুমড়ো ফুলের বড়া, মসুর ডাল, মোচার তরকারি, ঝুড়ি আলুভাজা ওটা শেষ হতে না হতেই দেশি মুরগির সোনালী ঝোল, লাল দই দুশো গ্রাম, আর ছানার পায়েস সহযোগে ক্ষীর পেলাম। খবর নিলাম রাতে কলকাতা মুখী বাস আসবে এই পোকা বাঁধে সময় রাত 12টা নাগাদ বাসের নাম "নাইট কুইন বাস"।
 অপেক্ষায় আছি কখন রাতের রানী আসবে আর আমায় শো করে তুলে নিয়ে যাবে কোলকাতায় । ডানলপ এসে পৌঁছলাম প্রায় ভোর চারটে।
বাসে আসতে আসতে ভাবছিলাম সারাদিন হয়তো আমি আর ঐ রিকশাওয়ালা দুজনেই খুবই কষ্টের খাপ খুলেছি নিজেরা নিজেদের, কিন্তু দিনের শেষে পরিশ্রমের ক্ষীর টা খুবই মধুর ছিল ।সেই কারণেই হয়তো জায়গাটার নাম "খাপকাটা ক্ষীরপাই" যা আমার  স্মৃতি থেকে আজও এতটুকু বিলীন হয়ে যায়নি।


Comments

sadamata101.blogspot.com

B-47#বিশ্বকর্মা_পূজো

সন্তোষ ঢাকি

B-71#GANESH_PRASADAM. ( গনেশজির ভোগ নিবেদন মোদক ও পূরণ পুলি)