B-146# আমার বায়ুসেনার দিনগুলি (চতুর্থ ভাগ)
আমার বায়ুসেনার দিনগুলি (চতুর্থ ভাগ)
বিকেলে চা খেয়ে পনেরো মিনিটের বিশ্রাম ঠিক ছটায় আবার ফল ইন, সারাদিনে চারবার এই ফল ইন হয় । চায়ের সাথে হাল্কা স্ন্যাক্স জাতীয় খাবার খেতে না খেতেই চললাম সেই পরিচিত চিরাচরিত মাঠে সিনেমা দেখতে । বিশাল জায়ান্ট স্ক্রিন, ইচ্ছে করছে না, পারলে মাঠেই শুয়ে পড়ি এতটাই ক্লান্ত লাগছে, কিন্ত বলার উপায় নেই কর্তৃপক্ষের কাছে। বসে আছি আর পাঁচটা বন্ধুদের সাথে মাঝমাঠে। শুরু হোলো সিনেমা রাজকাপুরের বই “মেরা নাম জোকার”।
নামটা প্রথম শুনলাম যদিও আমার সিনেমার সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা বড্ড কম। মনে ভাবলাম সত্যিই তো জোকারই বটে। কি করছি কেন করছি কোনো কিছুরই বোঝার উপায় নেই, জীবন হাত ধরে টেনে নিয়ে চলেছে তাই নিয়েই চলেছি মন কিছুতেই মানছে না। বাড়িতে কতদিন যেন চিঠি দেই নি সেই বিশাখাপত্তনম থেকে শেষ পোস্ট করা চিঠি। সিনেমা শুরু হোলো মাঝে মাঝে নিক্সনের গায়ে এলিয়ে পড়ছি, সে আবার করে ঠেলা দেয় ধড়পরিয়ে উঠি। কিছুক্ষন পরে শুনি একটা জোর চীৎকার তাতেই ঘুম ভেঙে যায়।এ যেন মাঠের মধ্যে একটা শিয়াল ডাকলে বাদবাকি শেয়ালেরা ডেকে ওঠার মত অবস্থা। কর্তৃপক্ষ কাকে শাস্তি দেবে সবাই তো জোরে জোরে অন্ধকারে আওয়াজ করেই চলেছে।কারণটা পরে জানতে পারলাম আসলে আমি বোঝার আগেই সিন এগিয়ে গেছে অনেক আগে।ততক্ষনে কর্তৃপক্ষ সিনেমাও বন্ধ করে দিয়েছেন। সিমি গ্যারেওয়াল ও ঋষি কাপুরের একটা সিন আছে যেখানে সিমি স্নান করতে যাচ্ছে আর ঋষি কাপুর তা গাছের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। ব্যস সেটা দেখেই ছেলেদের হই হই রব।কে কাকে আটকায় তাতেই এক হুলুস্থূলু কান্ড। সিনেমা বন্ধ,চললাম বিলেটে মনে ভাবলাম যাক গিয়ে একটু সময় পাওয়া গেছে শরীরটা জিরোবে।দেখতে দেখতে আটটা বেজে গেলো ডিনারের সময় হয়ে গেলো।চললাম থালা মগ হাতে নিয়ে ডিনারে রাতে রুটি চারটে করে,একটা ভাজা সঙ্গে খেসারির ডাল আর ডিমের ডালনার মত লম্বা ঝোল।শেষে এক চামচ সুজির হালুয়া।খাওয়াটা বেশ মনোপূতঃ হোলো এই ছিল প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা।
রাতে থালা মগ ধুয়ে গেলাম বিলেটে, কিছুক্ষন পরে আবারও ফল ইন তারপর সেদিনের মত শেষ। কর্পোরাল বেবি এলেন পরের দিনের পাঠ শোনাতে, ভোরবেলায় পাঁচটায় ফল ইন বাকিটা সেখানেই বলবেন।মনে ভাবলাম আজকের দিনটাতো এখনো শেষ হোলো না, মাথায় আবার করে যন্ত্রনা দিয়ে গেলো কাল কি হবে। এভাবেই আরেকটা শিক্ষা ও অভ্যেস নতুন করে জন্ম নিল মনে, কাল কি করবো আজ তার আগাম প্রস্তুতি।সময় নষ্ট না করে তড়িঘড়ি শুয়ে পড়লাম আহাঃ কি মনোরম অনুভূতি, এ যেন মাংস, বিরিয়ানি বা পিঠে পায়েসের থেকেও এক অতিরিক্ত আত্ম তৃপ্তি যা এই মুহূর্তে ভোলার নয় । নিদ্রাদেবী আমার শরীরকে মুহূর্তে নিস্তেজ করে দিল ঘুমের দেশে গিয়ে স্বপ্নে নিয়ে গেলো পুরানো দিনগুলোতে যা আমার পেরিয়ে আসা দিনগুলো ছিল। অমনি মনে হোলো বাবা ডাকছেন গায়ে ঠেলা দিয়ে, হরবড়িয়ে উঠে ঘুম চোখে দেখি নিক্সন ডাকছে সেন ওঠো its fall in time, চেতনা ফিরলো বাস্তবে মনকে কল্পনার বিছানায় রেখে উঠে দাঁত মেজে, বাথরুম সেরে জুতো পরে fall in এ গিয়ে দাঁড়ালাম।
fall in শেষ হতে না হতেই চললাম সকলে মাঠের দিকে প্রথম দিন তাই চারপাক দৌড় হবে,আস্তে আস্তে সেটা বাড়বে। দৌড় শেষ করেই জগিং ও হাল্কা শারীরিক অনুশীলন এরপর কর্পোরাল বেবির ভাষণ।“তোমরা সকলেই নিজেকে ভাগ্যবান মনে কোরো তাম্বরমের মত একটা ট্রেনিং সেন্টারে এসে এখানের ট্রেনিং বড়ই হাল্কা ও সকলের কথা মনে করে তোমাদের একাধারে জওয়ান ও একাধারে সুদক্ষ প্লেন সংক্রান্ত মেরামতির ইঞ্জিনিয়ার তৈরী করা হবে। যা পরবর্তীকালে তোমাদের নিজেদেরই ভারতবর্ষের বিভিন্ন এরোনোটিক্যাল সংস্থার কাছে একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গড়ে তুলবে, শুধু দেশে কেন এমনকি বিদেশেও বিভিন্ন সংস্থার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার সুযোগ করে দেবে।আমার সামান্য দক্ষতা শুধুই তোমাদের জওয়ান ও সুষ্ঠ সাবলীল একজন নিয়মনিষ্ঠ মানুষ তৈরী করা এর বেশি নয়।একজন discipline মানুষ হতে গেলে যা যা প্রশিক্ষন তোমাদের দেওয়া দরকার আমার অতটুকুই কাজ। আমি নিজে ট্রেনিং প্রাপ্ত এক অসম্ভব কঠিন এয়ারফোর্স ট্রেনিং সেন্টার থেকে তোমরা নিশ্চয় প্রহার সিনেমাটা দেখেছো, সেটা যে জায়গার শুটিং আমি নিজেও সেখানকার। কর্ণাটকের বেলগাঁও নামটা মনে পড়ে সেখানেই এয়ারফোর্স স্টেশন sambra,এক ভারত বিখ্যাত ট্রেনিং সেন্টার।
সেখানে ট্রেনিং এর প্রথম দিনটার থেকে শুরু হয় প্রায় আট পাক দৌড়, তারপর বাকি কঠিন থেকে কঠিনতর ট্রেনিং তো আছেই।জীবনে এমনও দিন আসবে যেদিন তোমাদের উন্নতি বা প্রমোশন আমার থেকেও অনেক উঁচুতে হয়ে যাবে। তখন তোমাদের কারোর না কারোর সাথে কোনো এয়ারফোর্স স্টেশনে আমার দেখা হবে নিশ্চয়, তখন তোমাদের স্যার বলে স্যালুট করতে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হবো না তার কারণ একটাই মনে মনে ভাববো আমি যে সামনের মানুষটাকে স্যালুট করছি একটা সময় সে আমার কাছে ট্রেনিং প্রাপ্ত ছিল, তা জেনেই মনে মনে গর্ববোধ করবো”।যতদিন ছিলাম এই মানুষটার প্রতিটা কথা আমার কানে আজও বাজে অথচ পরবর্তী সময়ে এত কঠিন মানুষটা একদিন এতটা নরম হতে পেরেছিল অশ্রু বিগলিত চোখে মনের ভিতর জমে থাকা কথা এতই সহজ করে বলে দিয়েছিলো কোথাও যেন মেলাতে পারিনি। সকাল 6.30 বিলেটে এসে ব্রেকফাস্ট ব্রেক। ছুটলাম ক্যান্টিনে থালা হাতে চারপিস পাউরুটি জ্যাম, ডিম ও কলা। জ্যামটা ভারী সুস্বাদু আজও সে তৃপ্তি অনুভব করি বা সেরকম জ্যাম আজও জিভকে প্রলোভিত করে ।রবিবার তাই শুরু হোলো দুঘণ্টার গার্ডেনিং । বিলেটের সামনের বাগান পরিষ্কারের কাজ- পাতা কুড়োনো, জল দেওয়া, নতুন গাছ লাগানো সমস্তটাই শেখালেন কর্পোরাল বেবি। ওটা শেষ করেই ঘর পরিষ্কারের কাজ, বিছানা, মশারি কি ভাবে ভাঁজ করতে হয় সেটা পরিপাটি করে জানা।মশারি ভাঁজ করার যে একটা সুন্দর পদ্ধতি আছে সেটা তখনই শিখি একেবারে মনে হয় বর্গাকৃতি।এত সমস্ত করার পর কর্পোরাল বেবি এসে বললেন আজ কেউই স্নান কোরো না কারণ মাঠে নিয়ে যাবেন আবার চুল কাটতে।চললাম সবাই একসাথে সারিবদ্ধ ভাবে নতুন করে নিজেকে সাজাবো বলে। কেউ মিঠুন তো কেউ অমিতাভ, বাপের বাড়ির সাধের চুল, যে কালে বাবা বলতেন সে কালে কেউই শোনেনি। আজ সবাইকে শাবানা আজমীর আংশিক “গঙ্গাজল” করে দেবে নিমেষে। নাপিত ভায়া চুল নয় মাথা ধরলেন আর নিমেষেই খুর নামক যন্ত্রটা ধরে সপাটে মাথার সামনে পেছনে এক করে দিলেন।
একটা বড় আয়না সামনে একবারই দেখলাম, মনে মনে বললাম ওহে নাপিত ভায়া বাবা মা আজও জীবিত মস্তকমুন্ডন করে দিলে দেখছি। বলতে নেই নিজেকে আয়নায় দেখতে মনে হোলো প্রজেরিয়ায় আক্রান্ত, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে টিকালো নাক, কান দুটোতে গরম কালের গরম হাওয়া বেশি লাগছে, ঢুকছে বলে মনে হচ্ছে। ঝুলফি নেই আছে কানের পাশ দিয়ে নেমে আসা গুঁড়ো গুঁড়ো চুল মনে হোলো
শ্যাম্পু করলে সেগুলিও ধুয়ে যাবে।আরেক মজাদার অভিজ্ঞতা হোলো স্নান করতে গিয়ে একে তো গরম কাল। বেশ করে মাথায় শ্যাম্পু করেছি, সে ফেনা চোখ মুখ দিয়ে গড়িয়ে চোখ বন্ধ। কোনোভাবে হাতড়ে হাতড়ে শাওয়াররের নবে হাত পড়েছে “উড়ে বাবা এ কি! যেন কেউ গরম জল ঢালছে উপর থেকে”।কোনোভাবে স্নান সেরে চললাম লাঞ্চে, ভাবলাম রবিবারে দুপুর একটু আয়েস করে ঘুমোবো, তারপর উঠেই বাড়িতে গুছিয়ে চিঠি লিখতে বসবো।চব্বিশ ঘন্টা পেরোলাম যেন মনে হোলো কোথা থেকে সময় চলে গেলো বুঝতেও পারলাম না। অমনি কর্পোরাল বেবি এসে বললেন তিনটের সময় স্টাডি রুমে যেতে সেখানে নাকি খাতা বই দেওয়া হবে আগামী কাল থেকে ক্লাস শুরু। পিঠে স্কুল ব্যাগ নিয়ে আবারও ফিরে গেলাম স্কুল বেলায়, মন বললো এ জীবন আবার করে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো শিশুকালে।
https://sadamata101.blogspot.com/2021/02/b-147.html
Comments
Post a Comment
always