B-64# মাধু- প্রথম ভাগ. ( শুভ সুমেধার ত্রয়োদশ অধ্যায়)

মাধু
সুমি এই সুমি, কিরে আজ আটটা বাজে এখনো ঘুমোচ্ছিস। ভোর বেলায় হাঁটতে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় দেখি উঠিসনি। তখনই ভেবেছি কাল অনেক রাত্রি করে ঘুমিয়েছিস নিশ্চয়। মলি ফোন করেছিলো না রে? তাই এতো দেরি করে উঠছিস। নে নে দরজা খোল “ পান্থপথিক “ থেকে গরম গরম জিলিপি আর হিঙের কচুরি এনেছি, একসাথে খাবো বলে।
              ওহো নকাকিমা, আর বোলোনা কাল মলির সাথে কথা বলতে বলতে প্রায় রাত দুটো, তারপর একটা লেখালিখি চলছিল, সেটা সবে অর্ধেকটা হয়েছে,শুতে শুতে প্রায় রাত সাড়ে তিনটে। উফফ কি হাই উঠছে, ভালোই করেছো আজ আর টিফিন বানাতে ইচ্ছেই করছে না। দেখি মুখটা ধুয়ে চা বসাই।
    আরে বাবা আজ অনেক জরুরি কথা বলার জন্যই এসেছি, তাইতো এগুলো নিয়ে এলাম, রান্নাতে ব্যস্ত থাকলে আর কথা বলা হবে না। তুই মুখ ধুতে ধুতে শোন্ যা বলছি। বলছি একদিন আমি SOTC র হেড অফিসে ঘোরাঘুরি করছিলাম US যাওয়ার জন্য। ভিসা ওসব নিজের থেকে বানানো বড়ই মুশকিল, কোথায় দৌড়োবো, কে করে দেবে, তাই বলছিলাম তোদের পাসপোর্ট গুলো আমায় দে, আর হ্যাঁ ভালো কথা মলির তো  সামনে ছুটি আছে বলছিলিস, তাই ওর ছুটি দেখেই যাবো।
        ন কাকিমা কালই মলি বলছিলো আগামী মাসের শেষের দিকে ও বোধহয় দিন পনেরোর ছুটি পাবে তখন যদি যাওয়া যায়। আচ্ছা SOTC, মলিকে ওদের ট্যুর প্লানের সাথে কি ভাবে এডজাস্ট করবে, আগে সেটা জানা দরকার। কাগজপত্তর কি কি লাগবে বলো আমি সবই বার করে দিচ্ছি। আচ্ছা শোনো আগে চা তো খাও। শুভও আসছে ও বাথরুমে গেছে, তাহলে ট্যুর প্ল্যান টা একসাথে বসে সাজিয়ে নি। আর হ্যাঁ আরেকটা কথা আমাদের নতুন অতিথি মাধু তার সাথে পরিচয় করিয়ে দি ন কাকিমা, ও কাল এসেছে। শুভ একেবারে ক্যানিং লাইনে তালদি বলে যে স্টেশনটা আছে, সেখানে নেমে প্রায় অনেকটা ভ্যানে করে যেতে হয় ওদের গ্রামের নাম মরাপাড়া গ্রাম। দাঁড়াও ডাকছি। শুভ ও তার বন্ধু আলোক গাড়ি নিয়ে গেছিলো তাকে আনতে। আলোক থাকে বালিগঞ্জে, ওদের বাড়িতেই মাধুর বড়দিদি কাজ করে সেও একটা বিশেষ বড় নয়, বছর ষোলো কি সতেরো।
  মাধু, মাধু, কোথায় গেলি রে, কি রে কথাটা কানে যাচ্ছেনা বুঝি? কি রে শুনতে পারছিস। দেখেছো ন কাকিমা, কোথায় গেলো কোনো ঘরেই তো নেই, বাবা এতো মহা বিপদ।
এদিকে দেখছি সকাল সকাল উঠে বোধহয় ঘর ঝাড় দিয়ে, ঘর গুলো মুছেও দিয়েছে। বাইরে তো দেখছি ছাড়া কাপড়গুলো টানটান করে মেলেও দিয়েছে, তাহলে তো স্নান ও করে নিয়েছে বোধহয়। মেয়েটা গেলো কোথায় মাধু মাধু? সারাটা বাড়িতে নেই, উফফ আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, পরের মেয়ে এবার কি করি, আরে শুনছো শিগগির বের হও বাথরুম থেকে মাধুকে পাওয়া যাচ্ছে না।
                       আরে বাবা এতো চিন্তা করছিস কেন দেখবি যা তিনতলার ছাদে সে হয়তো আছে, বাচ্চা মেয়ে, এমনিতেই ওরা গ্রামের মেয়ে খোলামেলা জায়গায় থাকতে বেশি ভালোবাসে তোর ডাক হয়তো সে শুনতে পারছে না, চল দেখি আমিও যাই।
[ছাদে গিয়ে দেখি মাধু ফুল গাছ থেকে ফুল তুলে ঠাকুর ঘর পরিষ্কার করে ফুলগুলো সেখানে রেখে একমনে খেলা করছে আর পাড়ার বাচ্চারা যারা কুমির ডাঙ্গা খেলছে ছাদ থেকে আকারে ইঙ্গিতে কি সব বলছে। সে আছে তার বাল্যকালের খেলার জগতে, পেটের দায়ে কাজে এসেছে। দেখি রেলিংয়ের ফাঁকে জাফরী থেকে মাথা ঢুকিয়ে বলেই যাচ্ছে,ধূর তোরা খেলতে পারিস না
 এ খেলা সে খেলা নয় – এই মেয়েটা তোর নাম কি রে, কি বললি বুঝলাম না আরেকবার বলনা -বলছি না মিনা কানে কালা নাকি রে? উপর থেকে চীৎকার করে কি বলছিস কিচ্ছু শুনতে পারছি না। আরে আমি এবাড়ির কাজের মেয়ে মাধু, কাল এসেছি,আমার গ্রামের নাম মরাপাড়া গ্রাম তালদিতে থাকতাম, এখন এখানেই থাকবো। বলতে বলতে মাধু খেলার সে ছড়া আউরাতে থাকলো একমনে ছাদে।

“ইলাডিন বিলাডিন সইলো, কিসের খবর আইলো,
রাজা মশায় একটি বালিকা চাইলো,
কোন বালিকা চাইলো, ঝুপু বালিকা চাইলো”।
এতক্ষনে বোঝা গেলো ঝুপু হোলো মাধুর বন্ধু, যার সাথে সে খেলতো, তাই এখানেও সে কল্পনায় ঝুপুকে পায়, আর এখনো একমনে খেলে চলেছে]।
     কি রে মাধু, খেলেই যাচ্ছিস, কত করে ডাকছি তোকে কথাটা কানেই যায়না দেখছি। প্রণাম কর ইনি ন কাকিমা। সব কাজ তোকে কে বলেছে সকাল সকাল করতে। শোন্ নিচে চল, পরে খেলিস। খাবি তো কিছু নাকি? কি রে বললি না তো কখন উঠেছিস।
      উঠেছি বলছো কি ঘুম থেকে ? জানিনা তখন অন্ধকার ছিল বড়মা। গ্রামে তো সেই কাক ডাকলেই উঠে পড়তাম। একটা কথা বলবো বড়মা – আমি না মুড়ি খেয়েছি পেঁয়াজ দিয়ে, সকালে উঠে খেতাম তো তাই। গাঁয়ে অবশ্য প্রতিদিন হতো না খাওয়ার, তোমাদের এখানে কত খাবার গো। মুড়ি আমার খুব ভালো লাগে কেমন কড়কড় করে আওয়াজ হয় খেলেই মনে হয় কে যেন আসছে, আমার ভাই বাবু  আর আমি খুব খেতাম। একবার বাবু দাঁত দিয়ে কামড় দিয়ে আওয়াজ করতো তারপর আমি। তখন বাবু বলতো ঐ দেখ দিদি মনে হচ্ছেনা পায়ের শব্দ আর আমরা হাসতাম। এটা কি লুচি? তোমরা রোজ খাও? এ মা এটা তো জিলাপি আমরাও খেয়েছি। প্রতিবছর আমাদের মড়াপোড়া গ্রামে মেলা আসতো আর আমরা খেতাম। লুচি সবদিন না গো বড়মা ঐ গ্রামে বিয়ে বাড়ি হলে তখন।
আমি চা খাই না, বড়দি বলে “ওটা নেশার জিনিস মাধু খাস না “ তাই লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝে মাঝে খেতাম। আমি মাটিতে বসি, পা ছড়িয়ে, পা লম্বা করে কত ভাবে খাওয়া যায়, টেবিলে পা দুটো ঝুলিয়ে রাখলে ব্যাথা করে। এই দেখো ভুলেই গেছি প্রণাম করতে, বড়মা তুমি বলেছিলে না ছাদে। আচ্ছা বড়মা তুমি মাথায় কটা ইট নিতে পারবে? জানো আমার মায়ের কি শক্তি ছিল, আমার মা সেই মরাপোড়া গ্রামের ইটভাটায় দশটা ইট নিতে পারতো মাথায়। আমিও মায়ের সাথে যেতাম কাজে আমি বেশি না চারটে নিতাম, ভাটা বন্ধ হয়ে গেলো ব্যস শেষ।
    থাক থাক মাধু প্রণাম করতে হবে না, আচ্ছা বড়মা বলিস কেন? আর আমায় কি বলে ডাকবি বলতো? হ্যাঁ রে তোর বাড়িতে কে কে আছে শুনি। শোন্ পড়াশুনা কতদূর করেছিস, যাক তোকে নিয়ে আমাদের ভালোই সময় কাটবে কি বলিস সুমি দাঁড়া একদিন তোকে নিয়ে আমার ইস্কুলে যাবো, দেখবি কেমন মজা পাবি। তুই তোর ঐ খেলাটা যেটা ছাদে খেলছিলিস বাচ্চা গুলোকে শিখিয়ে দিস কেমন। ওরা অবশ্য অনেকে কথা বলতে পারে না, আবার অনেকে কানেও শুনতে পারে না।
     বড়মা কেন বলি বলতো, তুমি তো মায়ের থেকেও বড় তাই। পড়াশুনা আর হোলো কই। আমরা চার বোন দুই ভাই, এক দিদি লোকের বাড়িতে বালিগঞ্জে কাজ করে, আর আমার আরেকটা দিদি সে তালদি স্টেশনে রুটির দোকান, আমার পরে বোন আর ভাই, বড়দা সে কবে চলে গেছে চিনি ও না তাকে কেমন দেখতে ।বাপটা কিছু কাজ করে না, খুব নেশা করে। রাতে বাড়িতে এলেই মাকে মারে টাকার জন্য নেশা করবে বলে, একবার বাবা আমার ভাই কে মেরেই ফেলতো, ছুঁড়ে দিয়েছিলো তাই ওর মাথায় লেগেছিলো খুব, জানো বড়মা সেজন্যই তো আমাদের তালদির হাসপাতালের ডাক্তার বলেছে আমার ভাই পাগল। ওকে পাগল বললে ও খুব হাসে জানো। ভাই কোনোদিন কাঁদে না জানো খালি হাসে। মা আমার ঠিকমতো খেত না খাবার পাবে বা কোথায় ? যা খাবার বাঁচতো রেখে দিত আমাদের জন্য।
না খেতে খেতে একদিন এতো কাশি সেই তালদির ডাক্তারটা গো বড়মা কি বললো বলতো? কি জানি একটা বড় অসুখ হয়েছে। সেদিন খুব বৃষ্টি পড়ছিলো, আমি ভাবলাম ঠান্ডা লেগেছে তাই হয়তো কাশছে। সেদিন বাবা বাড়ি আসেনি, কোথায় পড়েছিল কি জানি। মা দেখি মুখ মুচ্ছে ঐ একটা নেকড়া দিয়ে সে কি অবস্থা সকালে দেখি মায়ের শাড়ি, নেকড়াতে রক্ত। সারারাত ধরে কেশেছে তো তাই দেখি রক্ত। সকালে মাকে ডাকি ওঠো বলে দেখি মা আর ওঠে না, মা  মরে গেছে। রাতে কি একটা কথা বলছিলো আমার মনে নেই ।
সেজন্যই তো দিদি বললো মাধু তুই কাজ কর লোকের বাড়িতে আর আমি রুটি বিক্রি করে যা পাবো তা দিয়ে বোন ভাইকে দেখে নেবো, টাকা দিস না হলে সংসার চলবে না। এই তো চারমাস হোলো, মা যেদিন মারা যায় ছোটো ভাইটা কিছুই বোঝে না, মায়ের পেটের উপর বসে শুধুই হাসছিলো। এখন মনে হয় বোঝে যে মা নেই মরে গেছে। এই তো গেলো গুরুবারে ঐ পাগলটা এতদিনে কাঁদলো, হয়তো মায়ের জন্য তার মনটা খারাপ লাগছিলো।




Comments

sadamata101.blogspot.com

B-47#বিশ্বকর্মা_পূজো

সন্তোষ ঢাকি

B-71#GANESH_PRASADAM. ( গনেশজির ভোগ নিবেদন মোদক ও পূরণ পুলি)